
লজ্জাবতী বানর এখন বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রজাতির বানর। সম্প্রতি এ দেশের চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার বনাঞ্চল এলাকার একটি রাবার বাগানে খাবারের সন্ধানে থাকা লজ্জবতী বানর আটক করে স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে বন্যপ্রাণীটি বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর না করে সেটিকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় রাখার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে বন আইন অনুযায়ী বন্যপ্রাণী উদ্ধার, সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের এখতিয়ার বনবিভাগের। কিন্তু প্রায়ই চিড়িয়াখানাটিতে বন্যপ্রাণী রাখার অভিযোগ উঠছে।
জানা গেছে, গত ৭ জুন ফটিকছড়ির বাগান বাজার ইউনিয়নের রাবার বাগান এলাকায় লজ্জাবতী বানর আটক করে স্থানীয়রা। পরে সেটিকে খাঁচায় আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার লোকজন গিয়ে বানরটিকে নিয়ে যায়। স্থানীয় বাসিন্দা সন্দ্বীপ সরকারি হাজী এবি কলেজের প্রভাষক নাজমুল হোসেন জানান, ”লজ্জাবতী বানরটি সরকারি রাবার বাগান সংলগ্ন লোকালয়ে চলে আসে। এরপর স্থানীয়রা সেটিকে ধরে ফেলে। বানরটির শরীরে অল্প আঘাতের চিহ্নও দেখেছি। খবর পেয়ে বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানাই।”
ফটিকছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সায়েদুল আরেফিন বলেন, ”লজ্জাবতী বানর উদ্ধারের খবর পেয়ে বন বিভাগকে বলি। তারা গিয়ে বানরটি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। পরে সেটিকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার লোকজন এসে নিয়ে যায়।”
লজ্জাবতী বানর উদ্ধারের বিষয়ে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ জানান, ”লজ্জাবতী বানরটি এখন মোটামুটি সুস্থ আছে। এটির বয়স চার বছর। উচ্চতা দেড় ফুটের মত, ওজন দেড় কেজি। এটি একটি পুরুষ লজ্জাবতী।”
বন্য লজ্জাবতী বানর বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর না করে কেন চিড়িয়াখানায় রাখা হলো এ প্রসঙ্গে কিউরেটর শাহাদাত হোসেন বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”যখন বনের কোন প্রাণী লোকালয়ে ঢুকে পড়লে স্থানীয়রা ধরে বনবিভাগকে জানায়। কিন্তু প্রায়ই বনবিভাগ এসব বিষয়ে রেসপন্স করে না বা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয় না। পরে স্থানীয়রা আমাদের জানালে আমরা প্রাণীটির জীবন রক্ষার্থে বা চিকিৎসার প্রয়োজনে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসি।”
প্রাণীবিদদের মতে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল বন্যপ্রাণীর হটস্পট। বিলুপ্ত প্রায় বহু প্রাণী এখনো টিকে রয়েছে এ জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চল এলাকায়। তবে অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনাঞ্চলে বিচরণ করা বন্যপ্রাণীগুলো আটক হলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা সেগুলো এনে খাঁচাবন্দী করে। যা বন আইন বিরুদ্ধ। এখনো চিড়িয়াখানাটিতে আইন না মেনে রাখা হয়েছে বহু বন্যপ্রাণী। গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় বনাঞ্চল এলাকা থেকে আটক একটি অজগরও চিড়িয়াখানায় রাখার অভিযোগ রয়েছে।
এসব অভিযোগ এবং উদ্ধারের পর চিকিৎসা দিয়ে কেন পরবর্তীতে আটক প্রাণী সম্পর্কে কেন বনবিভাগকে অবগত করা বা সেটিকে বনাঞ্চলে ছাড়া হয় না প্রসঙ্গে চিড়িয়াখানাটির কিউরেটর শাহাদাত হোসেনের শুভ’র ব্যাখ্যা, “উদ্ধার করে কোন প্রাণীকে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করলে পরে দেখা যায় আবারো সেটি লোকালয়ে ফিরে আসে। তখন সেটির মানুষের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই প্রাণীটি রক্ষায় চিড়িয়াখানায় আনা হয়। এছাড়া লজ্জবতী বানরের মতো প্রাণী বনবিভাগ যে স্থানে অবমুক্ত করে সে বনাঞ্চলটি ওই প্রাণীটির বিচরণের জন্য সহায়ক কিনা তা যাচাই না করে অবমুক্ত করে থাকে। পরবর্তীতে প্রাণীটির জীবন সংকটে পড়ারও সম্ভাবনা থাকে। তবে চিড়িয়াখানায় রাখা হলে সেটি এদিক থেকে সুরক্ষিত থাকে।
বনাঞ্চল এলাকা থেকে লজ্জবতী বানর উদ্ধার করে চিড়িয়াখানায় রাখার বিষয়টি বন আইন ও সংরক্ষণের নিয়মের গুরুতর লঙ্ঘণ বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ। তিনি বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, যেকোন বন্যপ্রাণী উদ্ধার বা সংরক্ষণের নিয়ম আছে। যেকোন মানুষ, চিড়িয়াখানা বা সংস্থা কোথাও থেকে কোন বন্যপ্রাণী উদ্ধার করলে সঙ্গে সঙ্গে তা বনবিভাগকে অবগত করতে হবে। বনভিবাগের সহযোগিতা না পেলেও প্রাণীটিকে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে হবে। তবে কোনভাবেই খাঁচায় ভরে রাখা যাবে না। আর চিড়িয়াখানারও এখতিয়ার নেই এভাবে বিরল প্রজাতির বানর রাখার।
”লজ্জবতী বানর বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বানর। ঢাকার মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায়ও একটি লজ্জাবতী বানরও নেই সেখানে দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির এই বানর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়ও রাখার সুযোগ নেই,“ উল্লেখ করেন গবেষক আদনান। বলেন, “লজ্জবতী বানরের মূল খাবার বিভিন্ন গাছের আঠা, মথ, কচিপাতা ও পোকা। তাই ফটিকছড়ির ওই রাবার বাগানই লজ্জাবতী বানরটির উপযুক্ত পরিবেশ ছিল।”
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বন্যপ্রাণী রাখার বিষয়ে গবেষক আদনান বলেন, ”আমি নিজেও গিয়ে দেখেছি, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার খাঁচায় আরো লজ্জবতী বানর রয়েছে। যেগুলো দেয়া খাবারও সঠিক ছিল না। শুধু কলা খেতে দেয়া হয় বানরগুলোকে, যা বানরটির ফুড হেবিটের সঙ্গে মিল নেই।”
”লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী সম্পূর্ণ। এরা সূর্য আলো লাগলে বানরটির চোখে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরা দিনে গাছ লুকিয়ে থাকে এবং হাত ও পা দিয়ে চাপ দিয়ে মুখ ঢেকে বলের মতো গোল হয়ে থাকে, যাতে আলো না লাগে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও লাউস পর্যন্ত এদের বিচরণ, “ জানান বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ।
এর আগে গত ২ এপ্রিল ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের পূর্ব সোনাই গ্রাম থেকে আরেকটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার হয়েছিল। লজ্জাবতী বানরের ইংরেজি নাম বেঙ্গল স্লো লরিস। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে বানরটিকে দেখা যায়। প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএন লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনের তফসিল-১ অনুসারে সংরক্ষিত প্রাণী লজ্জাবতী বানর।