‘বন্যবানর ও ভ্যাক্সিন ট্রায়াল’

একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবর হচ্ছে- ‘টিকার পরিক্ষার জন্য বানর ধরতে গিয়ে কর্মকর্তাসহ পাঁচজন লাঞ্ছিত’। জানা যায়- গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড কর্তৃক আবিষ্কৃত কোভিড-১৯ টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ মানবদেহে প্রয়োগের আগে বানরের দেহে পরিক্ষার জন্য বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়। তাই ৫৬টি বানরের প্রয়োজন বলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড। পরে বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে তিনদিনে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এবং গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে ৩০টি বানর ধরে প্রতিষ্ঠানটি। বাকিগুলো গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী বাজার এলাকা থেকে ধরতে যায়।

রেসার্স ম্যাকাক বা বানর বা বান্দরের সাথে বিভিন্নভাবে মানুষের শারীরবৃত্তীয় মিল থাকায় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বা ভ্যাক্সিন মানবদেহের জন্য ব্যবহারের আগে বানরের দেহে পরিক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- এ ধরনের ট্রায়াল কি ফ্রি-র‌্যাগিং বা বন্যবানরে করা হয়? নাকি ল্যাবে জন্ম নেয়া সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত বানরে ব্যবহার করা হয়?

বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ কি বন্যবানরের ওপর এই ট্রায়াল করতে বলেছে? অনুমতি দেয়ার আগে বন্যবানরের ওপর এ ধরনের ভ্যাক্সিন ট্রায়াল করা যায় কিনা সেটি খতিয়ে দেখেছে কি বাংলাদেশ বনবিভাগ? বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ বিষয়ক এনিম্যাল মডেল ব্লু-প্রিন্ট আনুযায়ী এই প্রোটোকল অনুমোদিত কিনা দেখা হয়েছে কি? এই প্রোটোকলে এথিক্যাল এবং প্রাণী সুরক্ষার বিষয় মানা হয়েছে কি? ট্রায়ালের অনুমতি বন্যপ্রাণী আইন-২০১২ অনুযায়ী বন্যপ্রাণী বিষয়ক বৈজ্ঞানিক কমিটি এবং বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড থেকে কি অনুমোদিত? ট্রায়ালের পর বানরগুলো কি করা হবে তা ভেবে দেখা হয়েছে?

কেন ফ্রি-র‌্যাগিং বা বন্যবানরের ওপর ভ্যাক্সিন ট্রায়াল উচিত না?

যেসব বানর মানুষের কাছাকাছি থাকে বা বনে থাকে সেগুলোকে সাধারণত অ-নির্দিষ্ট-রোগ-মুক্ত (এসপিএফ) হিসাবে গণ্য করা হয়। এসব বানরের বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণু থাকে। যা যে কোন ট্রায়ালের ফলাফলকে প্রভাবিত করে। ২০০৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্টের ইউনির্ভাসিটি অব ওয়াশিংটন এবং আমার যৌথ গবেষণায় দেখা যায়- বাংলাদেশের যে জায়গাগুলোতে (শ্রীপুরের বর্মিসহ) মানুষের বসতির আশেপাশে বানর পাওয়া যায় সেসব বানররা বিভিন্ন ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশের বানরে মাইকোব্যাক্টেরিয়াম এসপিপি, পিকারনভাইরাস, প্যারামিক্সোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, অ্যাস্ট্রোভাইরাস এবং এনজুটিক ভাইরাস পাওয়া যায়।

উপরোক্ত জীবাণু বানর থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে বানরে সংক্রমিত হওয়ারও প্রমাণ পেয়েছি (কেউ আগ্রহী হলে এ সংক্রান্ত আমার প্রকাশনাগুলো দেখে নিতে পারেন)। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও একই ধরনের নজির পাওয়া যায়। তাই বিশ্বব্যাপী যখন কোন অ্যানিম্যাল মডেলিং করা হয় তখন খুবই সতর্কভাবে সম্পূর্ণ নীরোগ নির্দিষ্ট-প্যাথোজেন মুক্ত (এসপিএফ) প্রাণী ব্যবহার করা হয়। যাতে করে ভাইরাল ইনফেকশন বা ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে নরমাল ইমিউন রেসপন্স পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে উৎপাদিত কোভিড-১৯ টিকা বঙ্গভ্যাক্সের জন্য যেকোন সুনির্দিষ্ট-প্যাথোজেন-মুক্ত (এসপিএফ) প্রাণী এমনকি নির্দিষ্ট-প্যাথোজেন-মুক্ত (এসপিএফ) বানরে ব্যবহার করলেও কারো আপত্তি থাকার কথা না। কিন্তু আমার আপত্তি হচ্ছে- এ ধরনের একটি অনুমতি দিতে হলে সেটা অবশ্যই এ দেশের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী- বৈজ্ঞানিক কমিটি এবং বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড থেকে অনুমোদিত হতে হবে।

প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএনের লাল তালিকা-২০১৫ অনুযায়ী, রেসার্স ম্যাকাক বা বানর বা বান্দর বাংলাদেশে একটি সংকটাপন্ন প্রজাতির প্রাণী। বনবিভাগকে এ ধরনের যে কোন অনুমতি দেয়ার আগে সবকিছু খতিয়ে দেখে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করবো। মন্ত্রণালয় থেকে পাঠালেই অনুমতি দিতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা আছে বলে আমার জানা নেই।

আমি দীর্ঘদিন বৈজ্ঞানিক কমিটির সদস্য এবং সভাপতি থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক অনুমতির আবেদন বাতিল হতে দেখেছি। এই কমিটিটি রাখাই হয়েছে যাতে বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত যেকোন সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেয়া যায়। আশা করি বনবিভাগ সাফারি পার্ক থেকে ধরা বানরগেলো আবারো সাফারিতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সচেতন থাকবে।

লেখক: প্রাণীবিদ, বাংলাদেশে।

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।