হাওয়া সিনেমা, মামলা ও সম্ভাব্য পরিণতি

‘ঝি’কে মেরে বউকে শেখানো’ বাংলা ভাষার একটি পুরনো ও প্রচলিত প্রবাদ। একটা প্রবাদের প্রচলন হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হল ওই প্রবাদের বাস্তবিক প্রয়োগ। এ প্রবাদটি পুরনো হলেও এর বাস্তবিক প্রয়োগ এখনো হচ্ছে আমাদের সমাজে। এর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে – হাওয়া সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে বনবিভাগের আনীত অভিযোগ ও মামলা। কেন উক্ত প্রবাদটির সঙ্গে এই ঘটনা মিল রয়েছে তা ব্যাখা করা যাক।

কোন নাটক বা সিনেমায় বন্যপ্রাণি ব্যবহারের ঘটনা এই প্রথম নয়। আগেও বহু নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে বহুপ্রাণি প্রদর্শন বা ব্যবহার অহরহ ঘটেছে। কিন্তু তখন বন বিভাগ সেসবের বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু হাওয়া সিনেমার বিরুদ্ধে ঠিকই সুস্পষ্ট অভিযোগ এনে মামলা করেছে। এর কারণ কি পারে? সাধারণভাবে বিশ্লেষণ করে আমার মনে হয়েছে, মূলত হাওয়া যেহেতু দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে, তাই এই সিনেমা বা সিনেমা সসংশ্লিষ্ট কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা জনসাধারণের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এবং সবাই বন্যপ্রাণি বিষয়ক অপরাধ ও তার বিচার সম্পর্কে জানতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মানুষ এই বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক হবে।

কিন্তু মূলত যে বিষয়টা অধিকতর আলোচনার জন্ম দিয়েছে তা হল ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া। এত টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া কি আদৌ যৌক্তিক হয়েছে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, যারা বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যে কানাঘুষা, সামাজিক মাধ্যমে তর্ক-বিতর্ক ব্যাপক আকার নিয়েছে। অন্যদিকে হাওয়া সিনেমার পরিচালকের তো ঘুম হারাম হওয়ার মত অবস্থা। তিনিও নানাভাবে ব্যাখ্যা করে বন্যপ্রাণির প্রতি তার সহমর্মিতার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।

এমতাবস্থায় কি হতে পারে এই মামলার পরিণতি? যদিও আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের ভাবনার সাথে সবাই একমত হবেন, তেমনটা প্রত্যাশা আমি নিজেও করি না। তবে আমার ভাবনার সাথে আপনার ভাবনার কতটুকু মিল আছে, তা যাচাই করে দেখতেই পারেন। বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যাক কে জিতবে এই মামলায়? বন বিভাগ নাকি হাওয়া’র পরিচালক? আর পরিচালক যদি মামলায় হেরে যান, তাহলে কি হবে? ২০ কোটি টাকাই কি ক্ষতিপুরণ দিতে হবে?

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে হাওয়া সিনেমার পরিচালক কি আসলেই অপরাধ করেছেন?

হ্যাঁ, সিনেমায় শালিক পাখিকে খাচাবন্দি অবস্থায় ও হত্যা করে মাংস খাওয়া দেখানোর মাধ্যমে অপরাধ করেছেন তিনি।

কিভাবে অপরাধ করেছেন?

মামলার যে প্রথম ধারা (৩৮ এর ১ ও ২), তার ১-এ বলা আছে, কোন ব্যক্তি তফসিল ১ ও ২ এ উল্লিখিত কোন পাখি বা পরিযায়ী পাখি হত্যা করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। আর ২-এ উল্লেখ আছে, কোন ব্যক্তি তফসিল ১ ও ২ এ উল্লিখিত কোন পাখি, বা পরিযায়ী পাখির ট্রফি বা অসম্পূর্ণ ট্রফি, মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করিলে, দখলে রাখিলে বা ক্রয়-বিক্রয় করিলে বা পরিবহন করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। শালিক পাখি যেহেতু একটি তফসিলভুক্ত প্রজাতি, সেহেতু আইন অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে হাওয়া তো একটি সিনেমা। আর আইনে উল্লেখ আছে ব্যক্তির কথা। তাহলে পরিচালক কিভাবে দোষী হোন?

এই বিষয়টি ৪৬ ধারায় উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোন কোম্পানী কর্তৃক এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটিত হইলে উক্ত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে কোম্পানীর এমন সব ব্যক্তি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন। অতএব পরিচালককে আসামি হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়।

তৃতীয় প্রশ্ন হচ্ছে পরিচালক যদি দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে কি ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে?

উত্তর না। দিতে হবে না। ২০ কোটি টাকা তো অনেক পরের ব্যাপার। ২০ লক্ষ টাকাও দিতে হবে না। কেন দিতে হবে না? কারণ, ৩৮ এর ১ উপধারায় বলা আছে, উক্তরূপ অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৬ (ছয়) মাস পর্যন্ত অথবা সর্বোচ্চ ৩০ (ত্রিশ) হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। আর ৩৮ এর ২ উপধারায় যে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাও ৩৮(১) ধারার অনুরূপ।

মামলায় উল্লেখিত ৪১ ধারায় কি আছে?

সেখানে যা উল্লেখ আছে তা হল, কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করিলে বা উক্ত অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করিলে এবং উক্ত সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হইলে, উক্ত সহায়তাকারী বা প্ররোচণাকারী তাহার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৪১ ধারা অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হলে শুধু প্ররোচণা প্রদান করলেই হবে না। অধিকন্তু প্ররোচনার ফলে অপরাধ সংঘটিত হতে হবে। অতএব ৪১ ধারা মোতাবেক অন্তত এই মুহুর্তে হাওয়া সিনেমার পরিচালক এখনো পর্যন্ত কোন অপরাধ করেননি।

মোদ্দাকথা কি দাঁড়াল?

হাওয়া সিনেমার পরিচালক সুমন সাহেব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ ভঙ্গ করে অপরাধ করেছেন বটে, তবে আইন অনুযায়ী তা খুবই লঘু অপরাধ। এজন্য ২০ কোটি টাকা জরিমানা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বড়জোর ৩০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা কয়েক মাস জেল হতে পারে। এর বেশি কিছু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

তবে আরো একটি দিক আলোচনা জরুরি। এই মামলার মধ্য দিয়ে বন বিভাগের আইনগত ও কাঠামোগত সক্ষমতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। তদুপরি জনসাধারণের পক্ষ থেকে বন বিভাগের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ-অনুযোগ রয়েছে। তাই শুধু ঝি’কে মেরে বউকে শেখানোর মধ্যে শ্বাশুড়ির কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। পাশাপাশি শ্বাশুড়ির নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোও দূর করতে হবে, বিশেষ করে সবার ক্ষেত্রেই সমান আইনি প্রয়োগ থাকতে হবে। অবশ্যই কাঠামো, কার্যক্রম, কার্যক্ষমতা ও কার্যকারিতার দিক দিয়ে হতে হবে আরো বেশি ‘স্মার্ট’।

লেখক: প্রভাষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।