কাঁটাতারের ওপারে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ

কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত। ছবি তুলেছেন: লেখক

কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বত। আমাদের বাঙালি রাধানাথ শিকদার নিখুঁত হিসাব করে এভারেস্টকে উচ্চতম পর্বত হিসেবে বের করার আগে পৃথিবীর মানুষ জানত কাঞ্চনজঙ্ঘাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া। এই পর্বতকে সিকিম ও নেপালে খুবই পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং হিমালয়ান মিথে ইয়েতি বা তুষারদানোর বসতি হিসেবে কল্পনা করা হয়।

কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮ হাজার ফুটের বেশি। ধারণার জন্য জানিয়ে রাখি, আমাদের ঢাকার উচ্চতা ১৩ ফুটের মত, কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা ৩২০০ ফুটের মত। সিকিম ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘাই ভারতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এভারেস্ট থেকে এর দূরত্ব ১২৫ কিলোমিটার। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি গ্লেসিয়ারের একটি থেকে তিস্তা নদীর জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অঞ্চলের বর্ষাও অনেকটাই নির্ভরশীল কাঞ্চনজঙ্ঘার গ্লেসিয়ার বেসিনের উপর। কাঞ্চনজঙ্ঘা নামটি বাংলা (তৎসম কাঞ্চন=স্বর্ণ, জঙ্ঘা=উরুস্থল) মনে হলেও এটি সম্ভবত স্থানীয় কাং চেং জেং গা থেকে এসেছে যার অর্থ, “তুষারের পাঁচ রত্ন”।

কয়েকদিন ধরে দেখছি পঞ্চগড় বা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়া নিয়ে খুব ট্রল হচ্ছে এদিক সেদিক। যে যেভাবে পারছে যেখানে সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি এডিট করে বসিয়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে। ব্যাপারটা এমন, যেন পঞ্চগড় থেকে এত পরিস্কারভাবে দেখা যেতেই পারে না! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যারা এমনটা ভাবছেন তারা আসলে কাছ থেকে উঁচু পর্বত দেখার সুযোগ পাননি কিংবা তাদের কল্পনার জগতেও নেই যে হিমালয়ান রেঞ্জ কত উঁচু ও বিশাল হতে পারে।

তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দুরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। পঞ্চগড় বা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় অক্টোবর-নভেম্বরে এটা নতুন কিছু নয়। এ বছর ভাল দেখা যাচ্ছে কারণ বায়ুদূষণ কম করোনার কারণে। আবহাওয়াও পরিস্কার, শীত নামেনি, কুয়াশা নেই। এমন পরিস্কার দেখা যাওয়া তাই খুবই সম্ভব। তবে কিছু ফেইক ছবিও ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেগুলো ধরাও আসলে খুব সোজা, অন্তত যারা বোঝেন।

কাঞ্চনজঙ্ঘার সাপেক্ষে বাংলাদেশের উচ্চতা খুবই নগন্য, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলে সেটা দিগন্তরেখা থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে আকাশের গায়ে দেখা যায়। নীচে আমার তোলা এই ছবিটি কাঞ্চনজঙ্ঘার তুলনামূলক কাছ থেকে তোলা, সান্দাকফু থেকে। সান্দাকফুর নিজেরই উচ্চতা ১২ হাজার ফুট। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা এখানে দিগন্তরেখার যেখানে দেখাচ্ছে, তেঁতুলিয়া থেকে তার বেশ খানিকটা উপরে দেখা যাবে। এছাড়া তেঁতুলিয়া থেকে নীচু পাহাড়শ্রেণীর (কার্শিয়াং, দার্জিলিং ইত্যাদি) বিশেষ অ্যাঙ্গেলের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কৌণিকভাবে কেটে দেয়। উঁচু পর্বতের আশেপাশের নীচু পাহাড়ের কৌনিক অবস্থান দেখে সহজেই বোঝা যায় আসলে কোন জায়গা থেকে ছবি তোলা হয়েছে।

এ বছর কিছু ছবি সত্যিই খুব চমৎকার এসেছে তেঁতুলিয়া থেকে, যার কারণ আগেই বললাম। যাদের বিশ্বাস হয় না তাদের বলে রাখি, এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর থেকেও হিমালয়ান রেঞ্জ দেখা যাওয়ার রেকর্ড আছে। এবছরের এপ্রিলে পাঞ্জাব থেকেও হিমালয়কে দেখা গেছে। নিজেদের দোষে পৃথিবীটাকে দূষণে দূষণে জরাজীর্ণ না করলে আরও অনেককিছুই আমরা দেখতে পেতাম। তবে মানুষ বলে কথা, চাহিদা আর লোভের তো শেষ নেই।

লেখক: ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য: লেখাটি লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া।