ঢাকার কুকুর: সংকট ও সমাধানের পথ

পথ কুকুর। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

ঢাকা, বাংলাদেশ: মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে কুকুর মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গি। কুকুরই মানুষের প্রথম পোষা প্রাণী। কিন্তু ঢাকা শহরে এই প্রাচীন বন্ধুত্ব যেন প্রতিনিয়ত এক বৈরি সম্পর্কের রূপ নিচ্ছে। কুকুরের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব, অসচেতনতা এবং সহিংস আচরণ এই সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।

কুকুর হত্যা: ঢাকা শহরের অতীত প্রেক্ষাপট

একসময় ঢাকা মহানগর কর্তৃপক্ষ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে কুকুর হত্যা করত। গবেষণা অনুযায়ী, ২০০৩-২০০৮ সালে প্রতি বছর গড়ে ২২ হাজার ৪১৫টি কুকুর গণহত্যার শিকার হতো। তবে আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, এভাবে কুকুর মেরে ফেলা তাদের সংখ্যা কমায় না, বরং বাড়িয়ে দেয়। ফলে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তাদের প্রতি মানবিক ও ইতিবাচক আচরণ অত্যন্ত জরুরি।

ঢাকা শহরের বর্তমান চিত্র

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)’র সহায়তায় পরিচালিত ২০২২ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রায় ৭৩ হাজার ৭৭৮টি কুকুর রয়েছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৭টি কুকুর এবং এদের মধ্যে মাত্র ২৬% বন্ধ্যাকৃত। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) তিন দফায় জলাতঙ্ক প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন করেছে।

সেন্টমার্টিনে কুকুর সংকট

২০২৩ সালে সেন্টমার্টিনে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, প্রবাল দ্বীপে কুকুর সংখ্যা ১,১৪৪। এখানকার প্রতি বর্গকিলোমিটারে কুকুরের ঘনত্ব ৩৪৯ এবং প্রতি ১০ জন মানুষের বিপরীতে ১টি কুকুর। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতি ১০০ জন মানুষের বিপরীতে ১টি কুকুরকে স্বাভাবিক ধরা হলেও, সেন্টমার্টিনে এই সংখ্যা চরম মাত্রায় বেশি।

বাংলাদেশে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের অগ্রগতি

এক দশকের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সম্প্রতি ‘দ্য ল্যানসেট রিজিওনাল হেলথ সাউথইস্ট এশিয়া’-তে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২.৮৩টি কুকুর রয়েছে এবং মোট পথকুকুরের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ। জলাতঙ্ক নির্মূলে ব্যাপকহারে টিকাদান কর্মসূচির ফলে দেশের প্রতিটি জেলায় বছরে প্রায় ২১,২৯৫টি কুকুর টিকা পেয়েছে।

আইনি কাঠামো ও মানবিক সমাধানের প্রস্তাব

‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯’ অনুযায়ী, কুকুর নিধন, অপসারণ, অঙ্গহানী, বিষ প্রয়োগ এবং অমানবিক আচরণ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইন কার্যকর করতে হলে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ অত্যাবশ্যক।

প্রস্তাবিত কার্যক্রম:

জাতীয় গাইডলাইন: মানবিক কুকুর ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রুত একটি আধুনিক ও টেকসই গাইডলাইন তৈরি করা।

প্রাণীকল্যাণ কমিশন: বাংলাদেশ প্রাণীকল্যাণ কমিশন গঠন, যা আইন বাস্তবায়ন তদারকি করবে।

সমন্বিত কর্মসূচি: স্থানীয় সরকার বিভাগ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ।

মানুষ ও কুকুরের সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য কেবল আইন নয়, প্রয়োজন সচেতনতা ও সমন্বিত উদ্যোগ। ওয়ান হেলথ পন্থায় কুকুর ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এই সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব।

লেখক: প্রাণী চিকিৎসক ও গবেষক, রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (জুনোটিক), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।