বাওড়ের পাখ-পাখালির সৌন্দর্যে বারোবাজার

বাওড়। ছবি তুলেছেন লেখক।

প্রাণ-বৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের হাওড়গুলোকে কমবেশি সবাই চেনেন ও জানেন। তবে বাওড়গুলো সম্পর্কে সকলে কী জানেন? নানা রঙ ও বিচিত্র জীব-বৈচিত্র্যের এ দেশে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে তৈরি হয় অশ্বক্ষুরাকৃতি জলাশয়- যেগুলো বাওড় নামে পরিচিত। শীত-গ্রীষ্মে ঋতু পরিবর্তনে পানির পরিমাণ কম-বেশি হয়।

পৃথিবী গ্রহের মোট স্থলভাগের ছয় শতাংশ এলাকায় রয়েছে বাওড়; ইংরেজিতে বলা হয় Oxbow Lake/অক্সবো লেক। এতে বোঝাই যাচ্ছে এই গ্রহে বাওড়ের গুরুত্ব কেমন। বাওড় হাজারও জীব-বৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। এ দেশের গঙ্গা-নিম্নবর্তী অঞ্চলে ছোট-বড় মিলে রয়েছে ৮৭টি বাওড়। আর বাংলাদেশের মোট আয়াতনের পাঁচ হাজার চারশো আটাশি হেক্টর এলাকা বাওড়ের অন্তর্ভুক্ত। যশোর, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা এবং খুলনা অঞ্চলে বাওড়গুলোর অবস্থান।

বালুহর, বেরগোবিনোদপুর, মরজাত, জয়দিয়া, ফাতেপুর উল্লেখ্য যোগ্য বাওড় হিসাবে পরিচিত। এই সকল বাওড়ে যেমন রয়েছে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ এর বৈচিত্র্যতা। ঠিক তেমনি এই বাওড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখপাখালির, স্তন্যপায়ী প্রাণীর সমাহার। রয়েছে শামুক, ঝিনুক, প্রজাপতি সহ বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর এক বিশাল সমাহার।

শীতের সকাল। কুয়াশার চাদর পারকরে, ছুটে চলছি ঝিনাইদহ, যশোর মহাসড়ক ধরে। গন্তব্য বারোবাজারের মরজাত বাওড়। সোনা রোদে সূর্য উকি দিচ্ছে মাথার উপরে। তার কিরণের আলো ঘুম ভাঙিয়েছে সূর্যমুখীর।

টিয়ারা এসে বসেছে সেই সূর্যমুখীর বীজ খেতে। দিগন্ত জোড়া ধানক্ষেত। এর বুকচিড়ে রাস্তা। খেজুর গাছের রসে পরিপূর্ণ হচ্ছে হাড়ি। তা আবার চুড়ি করে একটু খেয়ে নিচ্ছে শালিক আর শ্বেতাক্ষী। এদিকে নীল কন্ঠ সোনা রোদে গা গরম করে নিচ্ছে। ধবল বকেরা ঝাঁক বেধে উড়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে আর বাকি থাকেনা, পাখিদের স্বর্গরাজ্য সামনেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের খ্যাতিমান গবেষক ও শিক্ষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং মো. মাহাবুব আলমের তত্ত্বাবধানে, বিভাগের শিক্ষক মো. ফজলে রাব্বি’র সহযোগিতায় আমরা দীর্ঘ দু্ই বছরের বেশি সময় ধরে মারজাত বাওড়ের পাখি, জীব-বৈচিত্র্য নিয়ে একটি বিস্তারিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করি।

বারোবাজারের পাখ-পাখালির তথ্য অনুসন্ধানও ছিলো এ কাজের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যও। এতে একটি বড় অংশ ছিলো নৌকা করে বাওড়ের বিভিন্ন অংশে পাখি দেখা। মরজাত বাওড় বাংলাদেশের বাওড়গুলোর মধ্যে অন্যতম বড় একটি বাওড় এবং পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে চিহ্নিত।

ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ে, আবাবিল এর উড়াউড়ি শুরু হয়, এদিকে সুইচোরা ডিগবাজি দিয়ে পোকা ধরে খাচ্ছে শূন্যে। মাঝে মধ্যে মাথার উপর দিয়ে সরালিরবড় বড় ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। ছোট ডুবরিরা ডুব দিচ্ছে আপন মনে। কিছুদূর এগোতেই বড় পানকৌঁড়ি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে মাছ শিকারের জন্য। পাতি পান মুরগি, পাতি কুট, চ্যাগাসহ বিভিন্ন পাখিদের স্বত:স্ফুর্ত বিচরণ। মাঝে মধ্যে হ্যারিয়ার, দু’একটি বহুরূপী শিকরে ঈগলসহ আরও নানা বৈচিত্র্যের পাখিদের ছড়াছড়ি। খঞ্জনরা লেজ নাড়িয়ে করছে নাচানাচি।

সৈকত পাখিরা আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে নিজের খাবার। বিভিন্ন প্রজাতির হটটিটিদের সেই উড়াউড়ি। চোখটা তখনই জুড়িয়ে গেলো যখন নৌকা বাওড়ের একেবার মাথার দিকে। নানা প্রজাতির পরিযায়ী হাঁসের সমাহার, লাল ঝুঁটি ভূতি হাস, বালি হাস, মরচেরং ভূতি হাঁস, পিয়াং হাস, পাতি তিলি হাসসহ অসংখ্য পাখির সমাহার।

জাল ময়ূরের চোখ জুড়ানো ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো, কাস্তেচোড়া, জল পিপিদের উড়াউড়ি, বগাবগলা,কালিম পাখি সৈকত পাখিদের ছুটে বেড়ানো। অন্যদিকে মাছ-মুড়ালের উড়ে বেড়ানো। সব মিলিয়ে যেন জলচর পাখিদের অপূর্ব এক স্বর্গ রাজ্য।

জল ও স্থল মিলিয়ে প্রায় দু’শো প্রজাতির পাখির এক অপূর্ব সৌন্দর্য এই এক বাওড়ে। দিন-মাস-ঋতু বদলায় সাথে সাথে পরিবর্তন হয় পাখিদের বৈচিত্র্যের। গ্রীষ্মে ডাকে কোকিল তার মায়বী কন্ঠে, অলস দুপুরে। নীল লেজ সুইচোরর গর্তে বাসা তৈরি করা থেকে ডিম পাড়া সব এই সময়েই। বর্ষায় বাওড় ফিরে পায় ভরা যৌবন।

এভাবে দিন ঋতুর পরিক্রমায় চলে সৌন্দর্য আর জীবনের রঙের অপূর্ব মিতালী। তবে পাখি শিকারের ফাঁদ, পাখি শিকার, অবৈধ বিক্রি এখানকার পাখিদের অন্যতম বড় সমস্যা, যা ক্রমাগত কমিয়ে দিচ্ছে পাখির সংখ্যা। এগুলো প্রতিরোধে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করা হয় বাওড়ের বিভিন্ন প্রান্তে। জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে নেয়া হয়েছে পাখি সংরক্ষণের উদ্যোগ।

শুধু মারজাত বাওড় নয়, বারোবাজারে রয়েছে মাজদিয়া বাওড়, ভৈরব নদসহ বিভিন্ন জলাশয়, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য পাখিদের এক ভূ-স্বর্গ। রয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। দরকার জরুরি সংরক্ষণ। বাওড়ের পাখি সংরক্ষণে দিতে হবে গুরুত্ব। কারণ বাওড়ের পাখিদের সৌন্দর্যে বারোবাজার হয়ে থাকবে চিরযৌবনা।

লেখক: বন্যপ্রাণ বিষয়ক গবেষক, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ।