বোস্তামী কাছিম: জীববৈচিত্র্যের অমূল্য রত্ন

বোস্তামী কাছিম। ফাইল ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার।

বাংলাদেশ: চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাথে এক গভীর সম্পর্কযুক্ত একটি প্রাণী – বোস্তামী কাছিম, যার বৈজ্ঞানিক নাম- নীলসোনিয়া নিগরিকেন্স। এই কাছিমটি প্রখ্যাত সুফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামী (রহ:) এর মাজারের পুকুরে বাস করে, যেখানে শত শত বছর ধরে এই প্রজাতিটি অবস্থান করছে। চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাজারে বিচরণ করা এই কচ্ছপগুলো আজও শহরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রতীক হয়ে রয়েছে।

বোস্তামী কাছিম বিশ্বে অত্যন্ত বিরল এবং বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে পরিচিত। এক সময় ধারণা করা হতো শুধুমাত্র চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের পুকুরে এই কাছিমটি পাওয়া যায়, তবে বর্তমান তথ্য অনুযায়ী, এই প্রজাতি এখন বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যেমন বান্দরবান, ফেনী, সিলেট, ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন জলাশয়ে এবং নদীতে পাওয়া গেছে। আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, এই প্রজাতি ভারতের ৯টি স্থানে, মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে এবং নেপালেও দেখা গেছে।

বোস্তামী কাছিমের আকার সাধারণত ছোট, কিন্তু বায়েজিদ বোস্তামী মাজারের কাছিমগুলো বড় আকারের হয়ে থাকে। সেখানে এই কচ্ছপগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। চট্টগ্রামের মাজারে ২০০৩ সালে গণনায় মোট ৭০০টি কাছিম পাওয়া গিয়েছিল, তবে বছরে প্রায় ৫০টির বেশি কাছিম মারা যায়, যা তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। এই কচ্ছপগুলোর অনেকের বয়স প্রায় ২০০-২৫০ বছর।

প্রজনন ও জীবনচক্র

বোস্তামী কাছিম প্রজনন মৌসুমে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ডিম পাড়ে। এক ডিমে সাধারণত ১২ থেকে ৩৮টি ডিম থাকে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৯৩ থেকে ১০৮ দিন সময় নেয়। এদের প্রজনন প্রক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক, যেখানে স্ত্রী কাছিম পুকুরের পাশে নরম মাটিতে গর্ত করে ডিম পাড়ে এবং সেগুলো মাটির সঙ্গে ঢেকে দেয়।

বায়েজিদ বোস্তামী (রহ:) মাজারে কচ্ছপকে খাবার দিচ্ছেন ভক্তরা। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

প্রাণীবিদদের মতে, বোস্তামী কাছিম মাংসাশী সরীসৃপ, এবং এই কচ্ছপগুলো পানির ক্ষতিকর বর্জ্য এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে পানি পরিষ্কার রাখে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি, তারা নিজের মধ্যে রোগাক্রান্ত বা মৃত কাছিমও খেয়ে ফেলে, যার ফলে পুকুরের বাস্তুতান্ত্রিক পপরিবেশ স্বাস্থ্যকর থাকে। আর শুধুমাত্র চট্টগ্রামে নয়, বোস্তামী কাছিম ভারতের ৯টি স্থানে, মিয়ানমারের আরাকান এবং নেপালে দেখা যায়।

সংরক্ষণের উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ

বোস্তামী কাছিমের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে বিভিন্ন কারণে। বসতি এলাকা ধ্বংস হওয়া, পর্যটকদের উৎপাত, পুকুর ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণ, পাচার এবং মানুষের শিকারে পরিণত হওয়া প্রজাতিটির সংখ্যা কমানোর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এই প্রজাতির সংরক্ষণে কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা, যার মধ্যে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলায়েন্স (সিসিএ) অন্যতম।

২০১৯ সালে সিসিএ একটি পাইলট প্রকল্প শুরু করে, যেখানে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার মাধ্যমে ১,১৫৫টি ডিম থেকে ৩১১টি বাচ্চা ফুটিয়ে পুকুরে অবমুক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি প্রতি বছর জুন-জুলাই মাসে শুরু হয়, যেখানে ডিম সংগ্রহের পর বিশেষ প্রক্রিয়ায় সেগুলো সংরক্ষণ করে বাচ্চা ফুটানো হয়। বাচ্চাগুলো ৬ মাস পর প্রজনন কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষণ শেষে পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয়।

পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

বোস্তামী কাছিম চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্যের অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত। এই কচ্ছপগুলোর সংরক্ষণ শুধু পরিবেশের জন্য নয়, স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগণের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে এই কাছিমগুলোর প্রতি একটি গভীর ভালবাসা এবং যত্ন রয়েছে, যা স্থানীয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বোস্তামী কাছিমের সংরক্ষণ স্থানীয় ইকোট্যুরিজমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের সম্ভাবনা তৈরি করে, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।

বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করছে সিসিএ’র সদস্যরা। ফাইল ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট ২৫ প্রজাতির কাছিম রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি স্বাদু পানি ও পাহাড়ি এলাকার এবং পাঁচটি সমুদ্রের। সামগ্রিকভাবে কচ্ছপের প্রজাতির সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম।

সচেতনতা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা

বোস্তামী কাছিমের সংরক্ষণ সচেতনতার প্রতীক হিসেবে কাজ করতে পারে, যা মানুষকে বিপন্ন প্রজাতির গুরুত্ব এবং তাদের বাসস্থানের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করবে। এর জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি, যাতে পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর সঠিক সংরক্ষণ করা যায়। বোস্তামী কাছিমের সংরক্ষণে যুক্ত সকল পক্ষের সহযোগিতায় এবং টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণে প্রজাতিটির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা সম্ভব।

বোস্তামী কাছিম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য অংশ। এই প্রাণীটির সংরক্ষণ শুধু পরিবেশগত কারণেই নয়, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি, কার্যকরী পদক্ষেপ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যাতে এই বিশ্ববিরল প্রজাতিটি ভবিষ্যতে টিকিয়ে রাখা যায়।

লেখক: প্রাণী চিকিৎসক এবং স্বেচ্ছাসেবী, প্রাণিসেবা ট্রাস্ট।

 

***প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত, বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয়বস্তু লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখার বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।