‘জ্বীন কাছিম’ অবমুক্ত বোস্তামির পুকুরে!

বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করছে সিসিএ’র সদস্যরা। ছবি: বেঙ্গল ডিসকাভার

বিশ্বে মহাবিপন্ন প্রজাতির বোস্তামী কাছিম। বোস্তামী মাজার কমিটি ও ভক্তকূলের মতে, নবম শতাব্দীতে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী যখন ইসলাম প্রচারের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন, তখন এই অঞ্চলে প্রচুর দুষ্টু জ্বীন এবং পাপীষ্ঠ আত্মার পদচারণা ছিলো। বায়েজিদ বোস্তামী সেসব জ্বীন ও  দুষ্টু আত্মাকে শাস্তিস্বরূপ কাছিমে পরিণত করেন এবং আজীবন পুকুরে বসবাসের দণ্ডাদেশ প্রদান করেন।

তবে প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলছেন, বোস্তামী কাছিম শুধু মাত্র চট্টগ্রামে নয়, ভারতের ৯টি স্থানে, মিয়ানমারের আরাকান ও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্ণফুলী ও  ব্রক্ষপুত্র অবিবাহিকার নদ-নদী অঞ্চলে দেখা যায় এ প্রজাতির কাছিম। খয়েরি ও কালচে রঙের এ কাছিমের ইংরেজি নাম: ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল/বোস্তামী টার্টেল/Bostami Turtle/black softshell turtle, বৈজ্ঞানিক নাম: নীলসোনিয়া নিগরিকেন্স/ Nilssonia nigricans

১৯৯৮ সালে বিপন্নপ্রায় প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন। ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত করে বাংলাদেশ। মহাবিপন্ন বোস্তামী কাছিমকে সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্স-সিসিএ। এরই অংশ হিসেবে ২০১৯ সাল থেকে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থাপনায় ১ হাজার ১৫৫টি ডিম থেকে মোট ৩১১টি বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা ফুটিয়ে তা পুকুরে অবমুক্ত করেছে সংস্থাটি।

সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী শাহরিয়ার রহমান সিজার বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “২০১৯ সালে ৫৫টি ডিম থেকে ৩৮টি বাচ্চা উৎপাদন করে বোস্তামী পুকুরে ছাড়া হয়। ২০২০ সালে ৭০০টি ডিম থেকে ২০৬টি বাচ্চা উৎপাদন হয়। ২০২১ সালে আমরা ৪০০টি ডিম সংগ্রহ করেছিলাম, সেখান থেকে ৬৭টি বাচ্চা উৎপাদন হয়েছিলো। নানা কারণে ১৪টি বাচ্চা মারা গেছে। আজ  ৫৩টি বাচ্চা বোস্তামী পুকুরে ছাড়তে সক্ষম হয়েছি।”

বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা অবমুক্ত করছেন মাজারের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান (ডানে) ও সিসিএ’র প্রধার নির্বাহী শাহরিয়ার রহমান সিজার (বামে)।

তবে আগের বছরগুলোর তুলনায় এ মৌসুমে কৃত্রিম ব্যবস্থাপনায় কাছিমের বাচ্চা উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে জানায় সংস্থাটি।

“মূলত করোনাকালীন কারণে সঠিক সময়ে ডিম সংগ্রহ করতে না পারা ও আবহাওয়াজনিত কারণে এমনটা হয়েছে বলে ধারণা করছি। তবে প্রাকৃতিকভাবে আগে এর চাইতে বেশি ডিম নষ্ট হতো। যা এখন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে,” যোগ করেন গবেষক শাহরিয়ার রহমান সিজার।

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্সের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ বন বিভাগ ও মাজার কর্তৃপক্ষ। মাজার প্রাঙ্গণে অবস্থিত পুকুরটির দৈর্ঘ্য ৯৮ দশমিক ৮ মিটার এবং প্রস্থ ৬১ দশমিক ৩ মিটার।

শত বছরের বেশি আয়ু নিয়ে জন্ম নেয়া বোস্তামী কাছিমের যে কটির জাত দেশের বিভিন্ন নদী-জলাশয়ে পাওয়া গেছে, সেগুলোর দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার। তবে বায়েজিদ বোস্তামী (র.)-এর মাজারের কাছিমগুলোর দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার থেকে এক মিটার পর্যন্ত। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় জীবন ধারণ করতে পারে বোস্তামী কাছিম। পুকুর সেচে ২০০৩ সালে এক গণনায় পাওয়া গিয়েছিল মোট ৭০০টি কাছিম। আর বছরে আনুমানিক ৫০-৬০টি বোস্তামী কাছিম মারা যায় বলে জানায় মাজার কর্তৃপক্ষ।

বায়েজিদ বোস্তামী রা: মাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “২০০৩ সালে দুর্বৃত্তরা বিষ প্রয়োগ করে পবিত্র মাজারের কাছিম হত্যার চেষ্টা করেছিলো। ওই ঘটনার পর বন বিভাগ ও প্রাণী গবেষকদের সহায়তায় কাছিম সুরক্ষার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য মাজারের পাশেই গড়ে তোলা হয়েছিল একটি কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র। এ কাজে মাজার কমিটি ও খাদেমরা সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন।

বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা।

কাছিম রক্ষায় বোস্তামী মাজার এলাকায় আরও একটি পুকুর খননের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন মাজারের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, “এতে কোনো কারণে একটি পুকুরের কাছিম ক্ষতিগ্রস্থ হলে অপর পুকুরের মাধ্যমে প্রজাতিটি সংরক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে।”

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্সের একদল দক্ষ সেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে কাছিমের কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি। স্বেচ্ছ্বাসেবী উচ্ছ্বাস বড়ুয়া বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে প্রজনন মৌসুমে আমরা কাছিমের ডিম সংগ্রহ শুরু করি। পরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ডিম সংরক্ষণ করে বাচ্চা ফুটানো হয়। আগষ্ট মাসে কাছিম ছানাগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানে ছয়মাস পর্যক্ষেণের পর ফেব্রুয়ারি মাসে কাছিমের বাচ্চাগুলোকে বোস্তামী পুকুরে উন্মুক্ত করা হয়।”

বোস্তামী কাছিমের বাচ্চা।

মাজার কর্তৃপক্ষ জানায়, আগে প্রজনন মৌসুমে মাজারের মূল পাহাড়ের পেছনে ও জঙ্গলে ডিম দিতো কাছিম। এতে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতো ডিম। ফলে বাধাগ্রস্থ হতো কাছিমের প্রাকৃতিক প্রজনন। কিন্তু ২০০৩ সালে যখন দুষ্কৃতকারীরা মাজারের পুকুরে বিষ প্রয়োগ করলে বোস্তামী কাছিম বিলুপ্তির শঙ্কা দেখা দেয়। ওই সময় বন বিভাগ ও মাজার কমিটি কাছিমের প্রজননের জন্য একটি জায়গা সংরক্ষিত করে। সেখানেই এখন কৃত্রিম উপায়ে চলছে কাছিম প্রজনন।

পৃথিবীতে এখন টিকে আছে ৩৬১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিম। এর ৫১ শতাংশ রয়েছে বিপন্ন অবস্থায়। বাংলাদেশে ২৫ প্রজাতির মিঠাপানির কচ্ছপ-কাছিমের দেখা যায়। এরমধ্যে ২১ প্রজাতির কচ্ছপ-কাছিমকে বাংলাদেশসহ বিশ্বে বিপন্ন, মহাবিপন্ন ও সংকটাপন্ন ঘোষণা করেছে প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএন।