ঢাকা, বাংলাদেশ – শীতের সকালে কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত গ্রাম অচিনপুর। সকাল সকাল কৃষক তার গরু, কাঁধে লাঙ্গল, হাতে কীটনাশক নিয়ে ছুটছে মাঠে, জেলেরা কাঁধে জাল। সবাই বিলের দিকে। আমার কাঁধে বড় জুমলেন্সের ক্যামেরা, আমিও যাচ্ছি ঠিক পাবনার ঘুঘুদহ বিলে। প্রবীণ এক পাখিবিদ থেকে জানা যায়, ওখানে খুব পাখি আসে। যদিও তার অভিজ্ঞতা আরও বছর বিশেক আগের। সেখানে নাকি বুনো হাঁস, ছোট-বড় জলচর পাখিদের আগমন ঘটে।
ওমা বিধি বাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর গেলেও তেমন কোন পাখির দেখা নেই। আর বিল কই এখানে এক ছোট, বয়স্ক জীর্ণশীর্ণ জীবনের পড়ন্ত বিকেলে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা এক জলাশয়। যার চারদিক কচুরিপানায় ঘেরা, আর কচুরিপানা পঁচে গিয়ে অদ্ভুত এক গন্ধ। কিছু সাদা বক, কয়েকটি ছোট পানকৌড়ি, দু-চারটি মাছরাঙা, শালিক, ময়না আর ভূবনচিল – এই হলো এখনকার পাখি।
কথা বললাম কৃষক জেলেদের সাথে। যা বুঝলাম এখানকার জলাশয় কেন্দ্রিক পাখিরা আরও আগে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে এখান থেকে। কিছুটা মন খারাপ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই, আশেপাশে ফলের বাগান। এখানে যা দেখছি তা দেখার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। ফলের গাছগুলো জাল দিয়ে ঘেরা, আর তাতে পেঁচিয়ে জীবনটাকে বাঁচাতে ছটফট করছে কাঠ ঠোকরা, ফিঙে, মুনিয়া, রাতচোরা দোয়েলসহ অনেক পাখি। মরে পড়ে আছে নিম প্যাচা, হাঁড়িচাচা, ঘুঘুসহ আরো পাখি। অথচ এরা কিন্তু কেউই ফলভুক নয়।
গ্রামের জলাশয়গুলোর পাখিরা কী ভালো আছে?
পাখি শিকার ও পাঁচার, নগরায়ন, বন উজাড়, শিল্পায়নের প্রভাবের বিষয় জানা যায়; কিন্তু পাশাপাশি পাখিদের নীরব ঘাতকদের বিষয়টি অজানা। যা এ দেশের পাখি বৈচিত্র্যকে দিন দিন ধ্বংস করে দিচ্ছে। তবে এই বিষয়টি জানা যাবে একটি নির্দিষ্ট এলাকার পাখিদের সম্প্রদায় গঠনের অবস্থা, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা এবং তাদের তুলনামূলক অবস্থান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট এলাকার আবাসস্থলে মোট পাখিদের কত অংশ কোন পাখি বা কোন শ্রেণির পাখি। যেমন জলাশয় কেন্দ্রিক আবাসস্থলে জলচর পাখিদের সংখ্যা তূলনামূলক বেশি, বনজ আবাসস্থলে বৃক্ষবাসী, কৃষি জমি এলাকায় পোকাখোড় ইত্যাদি।
এছাড়া কিছু পাখি আছে যাদের সকল ধরণের আবাসস্থলে পাওয়া যায়। আর পাখিদের নীরব ঘাতকেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় ও এর নিয়ামকের এমন পরিবর্তন ঘটাচ্ছে; ফলে পাখিদের তুলনামূলক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আবাসস্থল বিশেষায়িত পাখিদের সংখ্যা কমছে আর সাধারণ পাখিদের তুলনামূলক সংখ্যা বাড়ছে। এখন যদি খেয়াল করা হয় তাহলে দেখা যাবে জলাশয়কেন্দ্রিক পাখিরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকার জলাশয় গুলোর অবস্থা নাজুক। পাখি শিকার চোখে দৃশ্যমান হলেও জলাশয় গুলোর বিভিন্ন অজৈব নিয়ামকের পরিবর্তন পুরো বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
কিভাবে?
পৃথিবীতে সকল প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস যেমন এক নয়, ঠিক তেমনি আবাসস্থলও এক নয়। ঠিক একই রকমের পরিবেশ ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম খাদ্য সরবারাহের ফলে বিভিন্ন প্রজাতির পৃথক খাদ্য গ্রহন করে। আর আবাসস্থল বিশেষায়িত পাখিরা খাদ্যগ্রহনের ক্ষেত্রে আরও বেশি নির্দিষ্টতা বজায় রাখে। আর জলাশয়ে অজৈব নিয়ামক এর পরিবর্তন ক্রমাগত জৈব পদার্থ, খাদ্য উৎপাদক, খাদকের ওপর প্রভাব ফেলছে। ফলে প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় আসছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
এখন জলাশয় দূষণ, কচুরিপানার আধিক্যের ফলে দূষণ, কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনে জলাভূমিতে পানির স্তরের পরিবর্তনের ফলে ঘটছে এরকম ঘটনা। যার ফলে ঐ সকল পাখিরা হারাচ্ছে আবাসস্থল আর খাবারের ঠিকানা। গতবছর তিস্তা প্লাবনভূমি, চলনবিল, গজনারবিলে যখন যাই তখন চোখে পরে এই পরিস্থিতি। আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর জৌলুশ কিন্তু আগের মতো নেই। বলতে গেলে জলাশয় আছে, কিন্তু পাখি নেই। কারণ সেখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ঘটেছে পরিবর্তন। তার একটি বড় কারণ মাছ চাষ। কিন্তু অর্থনীতিকে চালিয়ে রাখতে তো মাছ চাষ জরুরি।
সমস্যা কী
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মাছ চাষের পদ্ধতিগুলোর সাথে পাখি বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সখ্যতা নেই। বাঁওড় আর বিলের উপর করা এক গবেষণায় বের হয়ে এসেছে এই তথ্য। শীতকালের শুরুতে যখন পরিযায়ী পাখিদের আগমন শুরু হয় ঠিক তখনই মাছ চাষের বা আহরনের জন্য চাপ পড়ে প্রকৃতিক জলাশয়ে। এর ফলে বিঘ্নিত হয় পাখিদের অবাধ বিচরণ। আর ক্রমেই কমতে থাকে পাখিদের সংখ্যা। বর্তমান সময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষতিকর জাল, যেমন চায়না দুয়ারি, এসব জালে আটকা পড়ে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখি সহ অন্যান্য জীব বৈচিত্র্য।
এখনকার সময়ে মানুষ তার বিনোদনের জন্য একটু প্রাকৃতিক পরিবেশ খোঁজে। অনেক সময় ছুটে যায় এই জলাশয়গুলোতে ভ্রমণে, ফলে মানুষের বিচরণ বাড়ে সেগুলোতে। আর ক্রমাগত পাখিদের অবাধ বিচরণের স্থান হয় পাখিশুন্য। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিলগুলো ক্রমেই কৃষিকাজের ফলে হারাচ্ছে তার জলজ পরিবেশের গুনগত মান। বিশেষ করে কীটনাশক ও সার জলাশয়ে মিশে যাচ্ছে। ফলে জলজ পরিবেশ হচ্ছে ক্রমেই বিষাক্ত আর সেখানকার পাখিরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও।
এখন পাখিদের একটি বড় সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়েছে ফলের বাগানে ফল রক্ষায় জালের ব্যবহার। এতে বাগানকেন্দ্রিক পাখিদের বিশেষ করে নিশাচর পাখিদের অবাধ বিচরণে তো বাঁধা আসছেই পাশাপাশি এই জালে আটকা পড়ে মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য পাখির। ফলে বাগানকেন্দ্রিক সেই পাখি বৈচিত্র্য কমছে। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে আমাদের গ্রামগুলো কিন্তু পাখি সংরক্ষণে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। কারণ গ্রামীণ পরিবেশের সবুজ বাগান, তরু, গুল্ম, পল্লব, সবুজ অরণ্য, খোলাপ্রান্তর স্থলচর বুনো পাখিদের উত্তম আবাসস্থল হিসাবে বিবেচিত ছিলো।
বর্তমানের গ্রামের কথা যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে আমাদের গ্রামগুলোতে কী আগের মতো দেশি গাছপালা, তরুলতা, গুল্মে ভরা ঘন বাগান-বাগিচার কী আর দেখা মেলে? গ্রামে সবুজ ঠিকই আছে, কিন্তু ওই সবুজে প্রাণ কতটা টিকে আছে এটা প্রশ্ন থেকে যায়। ক্রমেই বাড়ছে গ্রামের জনসংখ্যা। আর ঐ জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ক্রমেই বাড়ছে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি, হাটবাজার কিংবা স্থাপনা। আর এতে করে আমরা অজান্তেই হারিয়ে ফেলছি আমাদের সেই সকল সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। বিশেষ করে বুনোফুলে ঘেরা তরুলত গুল্ম। আর তার ওপর নির্ভর করে থাকা পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে সেই পরিবেশ থেকে।
শহুরে পাখিরা কেমন আছে?
শহুরে এলাকায় আবাসস্থল হারিয়ে জীববৈচিত্র্য যে কতটা ঝুঁকিতে তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু শহুরে যে পার্কগুলো, এক চিলতে সবুজ পরিবেশ ছিলো তা ধীরে ধীরে আরও হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে চিত্ত বিনোদনের নিমিত্তে পার্কগুলো ব্যবহারের কারণে সেগুলো ক্রমেই সৌন্দর্য বর্ধনের আওতায় আসছে। আর এই জায়গাগুলোর দেশি লতাগুল্ম হারিয়ে স্থানগুলো ভরে উঠছে সৌন্দর্য বর্ধক গাছে। ফলে শহরগুলো একেবারে হারিয়ে ফেলছে বুনো পাখিদের কলকাকলি।
বেশি দূরে যেতে হবে না, ঢাকা শহরের কথাই একটু চিন্তা করি। এখানকার গার্ডেন বা পার্কগুলো বর্তমানে এতটাই সৌন্দর্য বর্ধনের নামে পরিবর্তন করা হয়েছে। পাঁচ বছর আগেও যে পরিমাণ বুনো পাখিদের আনাগোনা এখানে ছিলো, বর্তমানে তার অনেকটাই নেই। বুনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে আজ এই পার্কগুলো জীর্ণশীর্ণ অবস্থা। এ দেশের পরিচিত পাখির ঝুঁকি, পাখি শিকার, পাচার, চোরাচালান, নগরায়নের বাইরেও আরও অনেক কারণ রয়েছে, যারফলে বাংলার পাখিরা আজ বিপন্ন। বাংলাদেশে আবাসস্থলজনিত সমস্যার কারণে ক্রমেই হুমকির মুখে পাখিরা। পাখিদের আবাসস্থল নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা, গবেষণার ফলাফলের ওপর কারণগুলো খুঁজে বের করা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া বাংলার পাখি সংরক্ষণ অলীক স্বপ্নেই থেকে যাবে।