‘তের শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?’ ১৩০০ নদী! সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার এই কথা আজ রূপকথার গল্প মনে হতে পারে। কেননা দখল ও দূষণে থেমে গেছে অনেক নদীর প্রবাহ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এখন টিকে আছে মাত্র চারশর মতো নদী। এগুলোর ভাগ্যও উদ্যোগ, নির্দেশনা ও সুপারিশের মধ্যেই আটকে আছে। অথচ নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে রক্ষার জন্য দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় এবং নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে নেই দৃশ্যমান অগ্রগতি। একদিকে দখলকারী উচ্ছেদ হলে অন্যদিকে আবার হয় দখল। এ ছাড়া একটি মডেল বা আদর্শ নদী তৈরি করতে না পারা দেশে নদী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৯ সালে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার আশপাশে চার নদীর দূষণ, অবৈধ দখল ও নদীগুলোর ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা অপসারণ, সিএস এবং আরএস ম্যাপ অনুসারে নদীগুলোর সীমানা জরিপ, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন ঘোষণা, নদীগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রণয়নসহ ১১ দফা নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। এ ছাড়া ২০১১ সালে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে তিন দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। ২০১৯ সালে তুরাগসহ দেশের সব নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। কিন্তু কোনো নির্দেশনাই এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
রিভার ও ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এখন পর্যন্ত একটি মডেল নদী আমরা করতে পারিনি, যেটিকে সম্পূর্ণ দখল ও দূষণমুক্ত বলা যেতে পারে। একটি নদীকে মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে : নদীর অবাধ পানিপ্রবাহ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও পলির অবাধ প্রবাহ। অর্থাৎ নদীর বাস্তুতন্ত্র ও পলিপ্রবাহ ঠিক থাকতে হবে। মোহাম্মদ এজাজের ভাষায়, নদীকে বাঁধমুক্ত রাখতে হবে। বালুমহাল উচ্ছেদসহ পুরোপুরি দূষণমুক্তও করতে হবে নদীকে। অথচ উজান ও শহরের নদীগুলোতে পানির অবাধ প্রবাহ নেই। গত ৫০ বছর দেশের যত নদী দেখেছি, সেগুলোর মূল চারটি দিকের উন্নতি হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু তালিকা প্রকাশ করাই জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাজ নয়। বরং নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার মতো উদ্যোগ নিতে হবে কমিশনকে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর এ বছরের ১৭ মার্চ অর্থাৎ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকীর মধ্যেই ঢাকার চার নদীকে দূষণমুক্ত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু তা শুধু ঘোষণা পর্যন্তই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ব্যক্তিনির্ভর। এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এটি। কমিশনের কোনো লোকই নেই, যিনি নদী রক্ষার উদ্যোগ নেবেন। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বদনা পানিও দূষণমুক্ত করতে পারেননি। কারণ উনার সেই সক্ষমতাই নেই। তিনি শুধু বক্তৃতাবাজি করে চলেছেন।
নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নদী দখলকারী। নদী ও নদীবিজ্ঞান বোঝে এমন কোনো লোকজনই নেই নদী রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে। দীর্ঘদিন নদী রক্ষার কথা বলছি। অথচ প্রকৃত কোনো উদ্যোগই দেখছি না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বালু নদকে একটি আদর্শ নদ হিসেবে তৈরি করতে প্রস্তাব করেছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু খুব একটা এগোনো যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে মডেল বা আদর্শ নদী আছে। জার্মানিসহ ইউরোপের আটটি দেশে প্রবাহিত রাইন নদী। দেশগুলো মিলে একক ব্যবস্থাপনার আওতায় মডেল নদী হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে। তেমনি অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘতম নদী মারে ডালিং, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে প্রবাহিত অন্যতম প্রধান নদী কলোরাডোকেও মডেল নদী হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নদী গবেষক মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, এ নদীগুলো অনেক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরপরও সব দেশ মিলে সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছে। অর্থাৎ দেশগুলো নিজ উদ্যোগে এবং আন্তঃসীমান্ত হলে প্রত্যেকটি দেশ সমন্বিত উপায়ে রক্ষা করছে নদীগুলো। তেমনিভাবে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোকে মহাব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যেতে পারে।
রাজধানীতে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। এ শহরের আশপাশে ছয়টি নদী থাকার পরও বসবাস অযোগ্য ৪০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ৩৯। তাই আগামীতে রাজধানীকে বাসযোগ্য করতে নদীগুলো সংরক্ষণের বিকল্প নেই বলে গবেষকদের দাবি।
এ শহরের নদীগুলোকে আদর্শ নদী হিসেবে বাস্তবায়ন করতে মহাপরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ দিয়ে বুয়েটের নদী গবেষক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, গুরুত্ব অনুসারে ঢাকার আশপাশের ছয়টি এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীকে আদর্শ নদী হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তবে ঢাকার ছয়টি নদী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বাসযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকাকে তৈরি করতে হলে অবশ্যই নদীগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ঢাকার চার নদীকে মহাপরিকল্পনার আওতায় মডেল নদী হিসেবে তৈরির সুযোগ আছে। এজন্য প্রথমত জরিপ ম্যাপ অনুযায়ী নদী দখলকারীকে উচ্ছেদ করতে হবে। নদীর সীমানা নির্ধারণ জরুরি।