বাংলাদেশের রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার থেগামুখ এলাকার অংশ থেকে এ দেশে প্রবেশ করেছে কর্ণফুলী নদী, ১৬১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। তবে এ দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ খ্যাত কর্ণফুলী নদী দখলে-দূষণে এখন বিপর্যস্ত। দিন দিন বাড়ছে নদীর জায়গা দখল ও দূষণ। মূলত শহরকেন্দ্রিক নদী এলাকাতেই দখল-দূষণ বেশি।
বিভিন্ন সময়ে এ নদীর দখল ও দূষণ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। কিন্তু কর্ণফুলীর উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে মোহনা পর্যন্ত তুলনামূলক চিত্র নিয়ে হয়নি বিস্তর কোন জরিপ। তবে চলতি বছরের জুন নাগাদ নদী বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি এবং প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক গণমাধ্যম ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ডিসকাভার যৌথভাবে জরিপটি পরিচালনা করছে। জরিপে তথ্য, গবেষণা, ও পর্যালোচনা পরিচালনায় লজিস্টিক ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করছে বেঙ্গল ডিসকাভার।
কর্ণফুলী নদীর দখল, দূষণ ও জীব-বৈচিত্র্যের সচিত্র অবস্থা জানতে “বেইজলাইন সার্ভে অব কর্ণফুলী রিভার” শিরোনামে চলতি বছরের প্রথম দিকে শুরু হয় বেসরকারি এ জরিপ। গেল ৩১ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় বাংলাদেশ অংশে কর্ণফুলী নদীর ১৬১ কিলোমিটার এলাকা চষে বেড়িয়েছেন গবেষক দলের সদস্যরা।
আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে কর্ণফুলীর দু’পাড়ের দখল-দূষণ, শিল্পকারখানার সংখ্যা, নগরায়ন, নদীর সাথে সম্পৃক্ত খাল, ঝিরি-ঝর্ণা, খেয়াঘাট, নদীর পাড়ের জনগোষ্ঠী, নদীর পাড়ের ভূমির ব্যবহার, নদী ভাঙনসহ নদীর প্রত্যেকটি পয়েন্টের জিও-লোকেশন তুলে এনে কাজ করছেন জরিপ দল। একইসঙ্গে নদীর অবাবহিকা থেকে মোহনা পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে নাব্যতা ও চরের জিও লোকেশন।
কর্ণফুলী নদীতে ছয় মাসব্যাপী এ জরিপ চালিয়েছেন গবেষকরা। এতে প্রধান গবেষক রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ এবং প্রধান সমন্বয়কারী বেঙ্গল ডিসকভারের সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম মিঠু, জিআইএস এক্সপার্ট মো. সাইফুল ইসলাম এবং ডিজিটাল ডকুমেন্টেশন এক্সপার্ট জাকির হোসেন।
নদীর প্রত্যেকটি পয়েন্ট ধরে উচ্চ প্রযুক্তির ডিজিটাল ড্রোন, জিপিএস ও স্যাটেলাইট ফটোগ্রাফির মাধ্যমে কাজ করেছেন গবেষকরা। আগামী জুন নাগাদ সরেজমিন সংগ্রহকৃত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, পরবর্তীতে চট্টগ্রামের নদী পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে এক্সপার্ট কনসালটেশনের পরে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে জানায় আরডিআরসি ও বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ।
রিভার এন্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “কর্ণফুলী নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রজেক্টে নদীর কিছু কিছু হটস্পটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে বিচ্ছিন্নভাবে জরিপ করা হয়েছে। কিন্তু নদীটি রক্ষার জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো জরিপ বা গবেষণা এর আগে হয়নি।“
”কর্ণফুলীর অববাহিকার বাংলাদেশের বর্ডার থেকে শুরু করে পতেঙ্গার বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত পুরো নদীর ১৭টি প্যারামিটার সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করে আমরা জিওলোকেশন আইডেন্টিফাই করার উদ্দেশ্যে একটা সার্ভে করছি। যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কর্ণফুলীকে রক্ষার জন্য যারা কাজ করবে বা করছেন তাদের জন্য আমাদের এই গবেষণা সহায়ক তথ্য ভান্ডার হিসেবে কাজে লাগবে,” যোগ করেন মোহাম্মদ এজাজ।
গবেষণার প্রধান সমন্বয়কারী, বেঙ্গল ডিসকভারের সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম মিঠু বলেন, “অফুরন্ত জীব-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ কর্ণফুলী নদীঘেরা অঞ্চল। কিন্তু দিন দিন কর্ণফুলী নদী ও দু’পাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন বেহালদশা। কিন্তু এর জন্য দায়ী কারা এবং কতখানি দায়ী তার সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা পরিলক্ষিত হয়নি। যা ছিল তা বিচ্ছিন্নভাবে নির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট ধরে করা হয়েছিল। বলা যায়, নদী দখল দূষণের সঠিক তথ্য থাকলে নদী রক্ষা করা সম্ভব।”
“মূলত নদীটি আগে কেমন ছিল, এখন কোন অবস্থায় আছে, দখল ও দূষণের নেপথ্যে কারা কতখানি দায়ী তা জানতে ও জানাতে সচিত্র এই জরিপটি পরিচালিত হচ্ছে। দখল দূষণের কারণে নদীর জীব বৈচিত্র্যে ওপর যে প্রভাবগুলো আসতে পারে তা এই জরিপের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া বেঙ্গল ডিসকভার যেহেতু প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে কাজ করে তাই পরিবেশ রক্ষায়, কর্ণফুলী রক্ষায় আমরা সব ধরনের সহযোগিতা চালিয়ে যাবো। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হবে নতুবা চট্টগ্রাম হারিয়ে যাবে,” যোগ করেন আমিনুল ইসলাম মিঠু।