মহারণ্যে একদিন

ছবি: লেখক

জনাপঞ্চাশেক কলেজ পড়ুয়া কয়েকটি জিপগাড়িতে বসে কিচিরমিচির জুড়েছে জঙ্গলময়। এক পিতৃসম মাস্টারমশাই দলনেতা , মাথায় তার একটি কাউবয় হ্যাট, পায়েতে গামবুট, গলায় দূরবীন ঝুলিয়ে, বর্ষাতি পরিহিত অবস্থায় জিপগাড়ি থেকে নামলেন, তার কঠোর দৃষ্টি সর্বদা ছাত্রছাত্রীদের ওপর বর্ষণরত। সহকারি দুজন মহিলা নামলেন পেছন পেছন, তেনারা মোটামুটি বেড়াতে এসেছেন দেখলেই বোঝা যায়।

প্রথম গাড়িটির বনেটের ওপর লাগানো ব্যানার এবং ছাত্রছাত্রীদের বর্ষাতির পিছনে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জ্বলজ্বল করে জানান দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। জুওলজি অর্থ্যাৎ প্রাণিবিদ্যা নিয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনরত। জিপগাড়ির দল মহিলাময়। জুওলজি বিষয়টি বোধহয় মেয়েরা বেশি মনোযোগ সহকারে পাঠ করে, ছাত্র সংখ্যা হাতেগোনা।

স্থান উত্তরপূর্ব ভারতের এক প্রত্যন্ত জঙ্গল, দশম শ্রেণির ভূগোল বইয়ে লেখা ছিল নিরক্ষীয় চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি (ট্রপিক্যাল এভারগ্রিন ফরেস্ট)। এই জঙ্গলে নাকি গাছের পাতা ঝরে না, নাকি ঝরলে বুঝতে পারা যায় না? পরিবেশ বই জানান দিয়েছিল, ময়েস্ট ডেসিডুয়াস ফরেস্টের। বঙ্গপোসাগরীয় মৌসুমী বায়ুর শাখা পূর্বাঞ্চল হিমালয় পর্বতমালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। সেই জল পান করে জন্ম নেয় উঁচু উঁচু বৃক্ষ, যার পাতায় পাতায় খেলা করে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁদুর।

এ জঙ্গলের ঘাসে ঘাসে ছুটে বেড়ায় বড় বড় হাতি, ধেড়ে ধেড়ে গন্ডার, প্রকাণ্ড বাইসন। কেঁদো কেঁদো বাঘ লুকিয়ে থাকে ঘাসের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, ছুটে ছুটে বেড়ানো হরিণ পাকড়ানোর আশায়। ডালে-ডালে, পালে-পালে গান গায় রঙ-বেরঙের পাখি। লম্বা লম্বা মগডালে শিকারি চক্ষু নিয়ে বসে থাকে চিল, বাজ, শকুন, ঈগল, মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়ানো ইঁদুর, বেড়াল, খরগোশ ছোট ছোট হরিণ, শুওরের ওপরের ঝাঁপিয়ে পড়ার বাসনায়। এ জঙ্গলে মাটিতে সূর্যালোক পৌঁছায় না, গাছের পাতা ঝরে পরে না, সর্বদা স্যাঁতস্যাঁতে, কর্দমাক্ত, অনুর্বর। আগাছা, গুল্ম জন্মায় সব ডালে-ডালে, কাণ্ডে-কাণ্ডে। মাটিতে পুষ্টির বড়ই অভাব।

ব্রহ্মপুত্র নদের শাখানদী, উপনদী এ জঙ্গলের মধ্যে নুড়ি, পাথর ছড়িয়ে দেয়। পাথরের খাঁজে-খাঁজে বাসা বাঁধে পোকামাকড়, তাদের সন্ধানে উড়ে উড়ে আসে ছোট ছোট চড়াই প্রজাতির পাখি। এসবের কারণ নাকি পরিবেশে আদ্রতার প্রাধান্য, বোধহয় জুওলজিতে পড়ানো হয়। বড় বড় পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলকে বিশ্বের বিস্ময়, জীববৈচিত্রের পীঠস্থান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যা রক্ষা করার কথা তাবড় তাবড় বনকর্তা এবং এই অঞ্চলে বসবাসরত বাদাম চক্ষু, হলুদ চর্মবিশিষ্ঠ, ছোট ছোট কপালের অধিকারী উপজাতিদের।

ছাত্র ছাত্রীদের কিচিমিচির শুনেই জঙ্গলের ইউনিফর্ম চট করে পড়ে বেড়িয়ে এলেন উপজাতি সম্প্রদায়ের বিট অফিসার। মাস্টারমশাইয়ের সহকারি মহিলারা প্রয়োজনীয় নথি দেখাচ্ছেন তেনাকে, ওয়ারলেসে রেঞ্জার সাহেব আদেশ দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের বনবাংলোয় যত্নসহকারে থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।

মাস্টারমশাইকে অথিতিশালার বড় ঘরটি দিতে হবে, কাল বড় সাহেব নিজে স্বয়ং আসবেন। মাস্টারমশাই প্রাণিবিদ্যায় দিগ্বিজয়ী বীর, দেশের সম্পদ, তার খাতির যত্নের বিশেষ নজর রাখার নির্দেশ দিলেন রেঞ্জার সাহেব। সমস্ত আদেশ কণ্ঠস্থ করে, বিট অফিসার সঙ্গিসাথীদের নিয়ে ছুটলেন বনবাংলোর পথে, আদেশ দিলেন ক্যান্টিনের প্রবাহীকে, রেশন জোগাড় করতে, মুরগির মাংস আর ভাত।

আমরা কয়েকজন যুবক একই বনবাংলোতে বসবাসরত। প্রকৃতির কোলে, স্নিগ্ধ পরিবেশে, নদীর কুলুকুলু শব্দে, পাখির গান শুনে, হাতির ডাক, বাঘের গর্জন শুনে দিন গুজরান করছিলাম মনের আনন্দে। আমার বন্ধু বলে উঠল, “কি আপদ, এখন এই লেডিস হোস্টেলে থাকতে হবে, বাকি দিন?”, বিট অফিসার ছুটতে ছুটতে বললেন, “বুঝুন তাহলে বিপদ, এই চলবে তিনদিন, তিনদিন”?

ছাত্রছাত্রীরা পিতৃস্নেহ, মাতৃস্নেহ থেকে স্বাধীন হয়েছে, শিক্ষকের অধীনে সাপের পাঁচ পা দেখবে ভেবে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে শুরু করবে, অমনি মাস্টারমশাই কড়া সুরে ধমক দিলেন। ছাত্রছাত্রীরা লাইন করে রওনা দিল আবাসিকস্থলের পথে। মাস্টারমশাই তার প্রিয়ছাত্রের গলায় একটি ক্যামেরা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, প্রিয় ছাত্র যারপরনাই আনন্দে যন্ত্রের সদ-ব্যবহার করে খটাখট ছবি তুলছে। আমাদের ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে থাকতে দেখে মাস্টারমশাই তার প্রিয় ছাত্রটিকে আমাদের জিম্মায় সপেঁ গেলেন আবাসিকস্থলের নিরাপত্তা, ব্যবস্থাপনা দেখতে।

এই খণ্ডিত বঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক হতদরিদ্র মুসলিম ক্ষেতমজুরের সন্তান মাস্টারমশাইয়ের প্রিয়ছাত্র। অজানাকে জানার অচেনাকে চেনার বাসনা তার প্রবল। আমাদের শুধোল, “আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে জঙ্গলে?” আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাহি করে জানালাম মাস্টারমশাইয়ের অনুমতি প্রয়োজন। আমাদের জিপগাড়ি চলে এসেছে, সূর্য মধ্যগগনে, আমরা যাব ‘বেঙ্গল ফ্লোরিক্যানের’ সন্ধানে, পৃথিবীর বুকে আর কয়েকটি মাত্র বিরজমান এই পাখি। প্রিয় ছাত্র মাস্টারমশাইকে সঙ্গে করে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে।

মাস্টারমশাই জানালেন, তার ছাত্র না করেছে স্নান, না খেয়েছে বিশেষ খাবার। আজকে তাদের জঙ্গলযাত্রার পরিকল্পনা নেই, ছাত্রের যাত্রাপথের ধকল সামলাতে বিশ্রাম নেওয়াই উচিৎ বলে মাস্টারমশাই মনে করেন। কিন্তু ছাত্র নাছোড়বান্দা, তার জীবন বন্ধুর, কঠোর, পরিশ্রমের যা মাস্টারমশাইয়ের চিন্তনের বাহিরে। সুযোগ জীবনে সে প্রথমবার পাইয়াছে, যা সে বিন্দুতে বিন্দুতে উপভোগ করতে চায়, প্রতিটি মুহূর্ত সে কিছু জানিতে চায়, শিখিতে চায়, সময়ের মূল্য তার কাছে অপরিসীম, সময় নষ্ট অপরাধ, মাস্টারমশাই “হায় বুঝবে কি ছাই ফুরফুরে দিন কেটে যায়।” কিন্তু মাস্টারমশাই বোঝেন ছাত্রের-জলের বোতল, বিস্কুটের কৌটো, ক্যামেরা, বর্ষাতি এবং গলায় দূরবীন পরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

কলেজের মাস্টারমশাই ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে জঙ্গলে পশুপাখি, গাছপালা, পোকামাকড় চেনাতে নিয়ে এসেছেন, সিলেবাসে ছত্রাক, অর্কিডও আছে। ২০০ করে নম্বর আছে চিল আর বাজের তফাৎ বলতে পারায়, শকুন আর উকুনের বলতে পারলে ৫০। হাতির কান দেখে বয়েস বলতে পারলে ৩৭ পাবে, গাছের পাতার শিরাবিন্যাস বলতে পারলে কথাই নেই, মাংস-ভাত খাওয়ানো হবে। বাঁদর চিনতে পারলে ২২, সাপ ও পোকামাকড় একমাত্র ছেলেরা চিনতে পারবে, মেয়েদের সে পথে যাওয়া নিষেধ এরকম অনেক নিয়ম আছে, এসবই শুনছিলাম প্রিয় ছাত্রের মুখে।

ঘাসের পাখি আকারে ছোট, রঙ খয়েরি কি বাদামি, হয়তো বা সবুজ, ঠোঁট ছোট বাঁকা। পাহাড়ের পাখি রঙবেরঙের, তাদের ল্যাজ দেখতে কি না সুন্দর, কন্ঠস্বর কি মিষ্টি, কি মিষ্টি। জলের পাখির বড় বড় ঠোঁট, বড় বড় পা, ডানা ভরা পালক তার। ছোট-বড় হাতি, শুঁড়ে করে ধূলো ওড়ায়, বাচ্চা হাতি শুঁড় দিয়ে জাপ্টে ধরে মায়ের ল্যাজ। গন্ডারের মা, সন্তানকে ছুটে ছুটে খেতে শেখায়। বুদ্ধদেব গুহর সাদা মোজা পড়া বাইসন আর সিং বেঁকানো মোষগুলি জলকেলি করে। সকলের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক কিন্তু হাতিদের মাতৃতান্ত্রিক তা প্রিয়ছাত্র জানে। ওয়াচ টাওয়ারে বেঙ্গল ফ্লোরিকান দেখে সে ফটো তোলে, আমাদের তার কৌটার বিস্কুট খেতে দেয়, সঙ্গের চকলেট। তারই কোনো এক অপরিচিত অগ্রজকে জঙ্গলের ভিতরে পশুপাখির সঙ্গে পড়াশুনার তাড়নায় বসবাস করতে দেখায় চোখের কোণে জল এনে ফেলে ভবিষ্যতের ভাবনায়।

এ জঙ্গলের মূল সড়কে আঁধারেও অনুমতি আছে চড়ে বেড়ানোর, সে রাস্তা পড়শী দেশে যায়, সঙ্গে থাকেন বন্দুকধারী সিপাহী। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে আলো ফেললেই চোখ জ্বলে ওঠে ইঁদুরের, বাদুড়ের, ফড়িঙের। কোনটা নাইটজারের, কোনটা চিতাবাঘের। পথভুলে রাস্তার ওপরে উঠে পরে ডোরাকাটা বাঘ, গাছের ওপর থেকে গুলগুল করে দেখে চিত্রপতি, ধনেশ পাখিরা হাঁক ডাক করে, লাফিংথ্রাসেরা ঝোপঝাড়ে হুটোপুটি করে। আর কারা যেন জঙ্গলে গান করে, “সুন্দরী কমলা নাচে।” কারা আবার, প্রিয় ছাত্রের সহপাঠীরা।

দিনের পালা সাঙ্গ শেষে আমরা বন বিশ্রামগৃহে, সেখানে উৎসবের আগমনী বাদ্যরত। এ জঙ্গলে আলোর উৎস্য একমাত্র সূর্য্যিমামা, তিনি ডুবিলে সম্বল তেনার তাপখেকো বাতি। অতিরিক্ত উৎসবে বাতির তাপ ফিলামেন্ট শুষে নেয়, ভরসা তখন ব্যাটারিচালিত টর্চ। আলোকের অনুপস্থিতিতে ছাত্রীছাত্রীরা গৃহমুখী হয়, আঁধার পূর্ণতা প্রাপ্তি করে, বনবাংলোর সামনের নদীর ওপর আলোক বর্ষিত হয় চন্দ্রপৃষ্ঠে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে, আমাদের বিট অফিসার গান ধরেন, “ও বিহোময মুংলী আও, মুংলী, রথো আয়োনোম রথো। “জঙ্গলেরও গান হয়, নিস্তব্ধতাকে উপভোগ করার জন্যে, যা বিট অফিসার জানেন।

লেখক: ভারতের প্রযুক্তিবিদ ও পরিবেশগত সমীক্ষার কাজে নিযুক্ত।