একটি ঋতুতেই বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বেশি শোনা যায় ব্যাঙের ডাক- সেটি হলো বর্ষাকালে। তবে জ্যেষ্ঠের মধ্যে বর্ষার বার্তা এনে যে বৃষ্টিপাত হয় তখনই নিয়মিত হতে থাকে ব্যাঙের ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ’ ডাক শোনা। বর্ষাকালে ব্যাঙের এই ডাক না থাকলে কেমন যেনো পানসে পানসেই লাগে! বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর এই শব্দ মানব মনে এক নতুন শিহরণ দিয়ে যায়।
শহর থেকে গ্রামের দিকে গেলে নানা প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে কুনো ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ তো হরহামেশাই দেখা যায়। সঙ্গে যোগ হয় নানা প্রজাতির সাপের আনাগোনাও। এই মৌসুমের বৃষ্টিপাতে সাপের আবাস্থল ভিজে যায়- তাই প্রাণীটি বেরিয়ে আসে উন্মুক্ত পরিবেশে। আর এ সময়ই প্রকৃতিতে সাপ-ব্যাঙের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্কটাও প্রকাশ পায় বেশি- কারণ ব্যাঙ যে সাপের অন্যতম শিকার বা খাদ্য! তাই ব্যাঙ পেলেই আক্রমণ করে বসে সাপ।
যাইহোক জ্যেষ্ঠের এই মধ্য সময়ে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত এ দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক অশোক চৌধুরী দাদার খামার বাড়িতে। প্রাকৃতিক এক বৈচিত্র্য যেন ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এই খামার এলাকার চারপাশজুড়ে। নানা প্রজাতির ফলজ, বনজ, ওষুধিসহ অজস্র লতাগুল্মে সাজানো খামারটি। রয়েছে নানা প্রজাতির পাখি, সাপ, ব্যাঙসহ পুকুর ভরা নানা প্রজাতির মাছ।
আগামীতে খামার বাড়িতে পালন করা হবে হরিণ ও ময়ূরের মতো প্রাণীও। ইতিমধ্যেই হরিণ-ময়ূর পালনে অনুমোদন প্রক্রিয়া চলছে, এর আগে জাতীয় চিড়িয়াখানা থেকে বরাদ্দ নেয়া হয়েছে হরিণ। তাই হরিণের রক্ষণাবেক্ষণের পরিবেশসহ খামারটি ঘুরে দেখে আসার আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন অশোক দাদা।
গতকাল ১৪ জ্যেষ্ঠ দুপুরে গিয়েছিলাম পটিয়ার খামার বাড়িটিতে। পুরো বিকেলজুড়ে খামারটি ঘুরে যখন সন্ধ্যা নেমে এলো তখনই পুকুর পাড়ের বৈঠক খানায় বসে ছিলাম। ঠিক তখনই হঠাৎ পরপর তিনটে ব্যাঙ উড়ে এসে বসলো আমার আশপাশে। এরমধ্যে একটি বসলো কাঁধে। রক্ষণাবেক্ষণে থাকা কর্মীরা জানিয়েছিল খুব সাপের আনাগোনা রয়েছে খামারে। এরমধ্যে বিষধর এবং নির্বিষসহ রয়েছে অজগরও।
প্রথমে ভেবেছিলাম কোন পোকা হাত দিতেই উড়ে গিয়ে বসলো সামনের টেবিলে। দ্রুত মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখলাম ব্যাঙ! তাৎক্ষণিক মোবাইল ক্যামেরায় কয়েকটি ক্লিক করলাম। মনে হচ্ছিল উড়ন্ত গেছো ব্যাঙ। কিন্তু কম আলোতে ঠিক পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। তবে একটি বিষয় ধারণা করলাম- ওই ব্যাঙ তিনটি খুবই ভীত ছিল। মনে হয়েছিল কোন শিকারি (সাপ) ওদের তাড়া করেছিল।
তোলা ছবিগুলো ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রধান প্রফেসর মনিরুল হাসান খান ও বন্যপ্রাণী গবেষক ও সম্প্রতি নতুন প্রজাতির আবিষ্কার করা গবেষক হাসান আল রাজীর কাছে। দু’জন প্রাণী গবেষকই জানালেন একই তথ্য। অর্থ্যাৎ এটি সাধারণ গেছো ব্যাঙ। ইংরেজী নাম: Common Tree Frog/কমন ট্রি ফ্রগ; বৈজ্ঞানিক নাম: Polypedates leucomystax/পলিপিডেটস লিউকোমিস্ট্যাক্স।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সচরাচর দেখা মেলে এই ব্যাঙের। তবে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইউসিএন’র তালিকায় এই ব্যাঙকে লিস্ট কনসার্ন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ আপাতত এ দেশ থেকে এই প্রজাতির ব্যাঙ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে এ ব্যাঙ প্রজাতি সংরক্ষণে করাও জরুরি।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬৩ প্রজাতির ব্যাঙের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা। তবে নানা প্রজাতির ব্যাঙের মধ্যে গেছো ব্যাঙ উড়তে পারে। অর্থ্যাৎ লাফিয়ে কয়েক ফুট উচ্চতায় বেশ দূর পর্যন্ত যেতে পারে। এই ব্যাঙেরা ঝোপে-ঝাড়ে, বনে-বাদাড় ও গাছে বাস করে। অন্যান্য ব্যাঙের চাইতে দেখতে অবশ্য একটু কমই বেঢপ আকৃতির হয়।
গেছো ব্যাঙের হাত-পা একটু বেশিই লম্বা ধরনের। আর লম্বা হাত ও পায়ের সাহায্যে ধাক্কা দিয়ে উঠে শূণ্যে ভাসতে পারে ব্যাঙটি। ভেসে ভেসে এভাবে পাড়ি দিতে পারে অনেকটা পথ। আবার যেখানে খুশি সেখানেও নেমে আসতে পারে নির্বিঘ্নে। এজন্য এদের পায়ের নিচে থাকে বিশেষ গ্রন্থি। যার মাধ্যমে অনেকটা টিকটিকির মতো যে কোন জায়গা বেয়ে নেমে উঠে যেতে পারে। পারে উড়ন্ত অবস্থা থেকে নেমে আসার সময় গাছ বা কোন কিছুর সঙ্গে গায়ে লেপ্টে যেতেও।
গেছো ব্যাঙ ডিম পাড়ার সময় পানির ধারে থাকা গাছকে বেছে নেয়, যার কিছু কিছু পানির ওপর বরাবর থাকে। এরা এদের ডিমগুলোকে এক রকম আঠালো নি:সরণের সাহায্যে ঠিক পানির উপরে পাতার গায়ে আটকে দেয়। ডিম ফুটে বের হওয়া ব্যাঙাচিগুলো সরাসরি পানিতে পড়ে যায়। ফলে ব্যাঙাচির বেঁচে থাকতে কোনো অসুবিধা হয় না।
গেছো ব্যাঙের থাবা থেকে সম্প্রতি ভারতের গবেষকরা এক ধরনের অতি শক্তিশালী এবং বারবার ব্যবহারযোগ্য আঠা আবিষ্কার করেছেন। গেছো ব্যাংর থাবার মশৃণ হস্তু রেখা” রয়েছে বলে আঠার শক্তির দুবর্লতা এড়ানো সম্ভব হয়। জানা গেছে- গেছো ব্যাংএর থাবার ওপর গবেষণা করে আবিষ্কৃত এই নতুন ধরনের আঠার শক্তি আগের সাধারণ আঠার শক্তির চাইতে ৩০ গুণ বেশি। উপরন্তু এ ধরনের আঠা বারবার ব্যবহার করাও যায়।