সেন্টমার্টিনে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। জনশ্রুতি আছে আনুমানিক ৩০০ বছর ধরে মানুষ বাস করছে এ দ্বীপে। প্রবাল দ্বীপের বাস্তুসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘কুকুর’ না হলেও কালের পরিক্রমায় ভ্রমণ পিপাসু লোকজন, ব্যবসায়ী ও জেলেদের হাত ধরে এসেছে প্রাণীটি।
নির্মল বিনোদন ও নিরাপত্তার খাতিরে সঙ্গে নিয়ে আসা কুকুরগুলো প্রয়োজন শেষে বেশিরভাগক্ষেত্রে রেখে চলে যান পালনকারীরা। প্রাণিটির বর্তমান স্ট্যাটাস বেওয়ারিশ। মুক্ত ভবঘুরে। অভিভাবকহীন এসব কুকুর সেন্টমার্টিনের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে, বংশবৃদ্ধি করছে। এজন্য তাদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের কুকুরের সাথে সেন্টমার্টিনে বিচরণ করা কুকুরের মধ্যে পার্থক্য আছে। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং নিরাপদ খাদ্যজালের কারণে সেখানকার কুকুরগুলোর স্বাভাবিক প্রজননহার অনেক বেশি এবং কুকুরছানার মৃত্যুহার অনেক কম। এজন্য অনিয়ন্ত্রিত কুকুর বৃদ্ধি প্রবাল দ্বীপের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, স্বাভাবিক বাস্তুসংস্থানের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পক্ষে ক্রমশ বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
২০২০ সালে সেন্টমার্টিনে ৯৩০টি এবং ২০২৩ সালে ৯১৭টি কুকুরে জলাতঙ্ক টিকা প্রদান করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি)। দ্বীপটিতে অত্যধিক কুকুর নিয়ন্ত্রণে টেকসই মানবিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে জাতিসংঘের উন্নয়ন সহযোগী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় সেন্টমার্টিনে কুকুর জরিপ ২০২৩ (সময়কাল: সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) পরিচালনা করা হয়। জরিপে পাওয়া তথ্য লিংকন-পেটারসন-চ্যাপম্যান এস্টিমেটর ইনডেক্স অবলম্বনে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেন্টমার্টিনে মোট কুকুর সংখ্যা ১১শ ৪৪টি (১০৯৩-১১৯৪; ৯৫%)।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য বলছে, প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমান জনসংখ্যা ১০ হাজার ৮৮৬। সেন্টমার্টিনর জনঘনত্ব এলাকা ৩ বর্গকিলোমিটার। এই হিসেবে দ্বীপটির প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮১টির বেশি কুকুর রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ মানুষের বিপরীতে ১টি কুকুর।
২০২১ সালের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং জাতীয় জলাতঙ্ক নির্মূল কর্মসূচির সহায়তায় জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার সমন্বয়ে ঢাকা শহরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর দুই সিটি অংশে মিলিয়ে প্রতি কিলোমিটার এলাকায় কুকুর রয়েছে প্রায় ১৭টি এবং শহরে মোট কুকুর সংখ্যা ৭৩ হাজার ৭৭৮টি। বৈজ্ঞানিক গড়পড়তায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় প্রতি একশো জন মানুষের বিপরীতে একটি কুকুর থাকাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। এখনকার সময়ে দেশের যে কোন নগর, মফস্বল, গ্রামের মোট আয়তন ও জনসংখ্যার বিপরীতে সর্বোচ্চ কুকুর ঘনত্ব সেন্টমার্টিনে। কাজেই জনঘনত্ব ও আয়তন উভয় বিবেচনায় প্রবাল দ্বীপে কুকুরের মোট সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত, চরম অস্বাভাবিক।
অত্যধিক কুকুর সেন্টমার্টিনের বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণি যেমন- সামুদ্রিক কচ্ছপ, লাল কাঁকড়া ডিমপাড়া হ্রাস ও তাদের নাটকীয় সংখ্যা হ্রাসে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করছে। অস্বাভাবিক কুকুর থাকার কারণে সেখানে কুকুর-মানুষ (ট্যুরিস্ট) বৈরীতাও বেশি। শুধু তাই নয়, অফ সিজনে যখন সেন্টমার্টিনে ট্যুরিস্টদের আসা-যাওয়া বন্ধ থাকে, তখন ওখানকার গৃহপালিত প্রাণি-পাখি এবং মাছবোঝাই বোটগুলোকেও তারা টার্গেট করে। এতে জনসবাস্থ্য বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়ে এবং জন-নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে তাদের নৃশংস নিধন কিংবা অপসারণ কোন স্থায়ী সমাধান নয়। কুকুর নিধন, অপসারণের কাজটি বেশ অমানবিক, বিপজ্জনক। পরিবেশ দূষণ ও রোগ সংক্রমণের বড় কারণ। এতে ব্যয়ও অনেক। এতে তাদের সংখ্যা আপাতত কমছে মনে হলেও পরবর্তীতে উল্টো বেড়ে যায়। কুকুর নিধন কিংবা অপসারণ বৈজ্ঞানিকভাবে অকার্যকর প্রমাণিত। এজন্য দেশের প্রচলিত ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯’ এর ধারা ৭ অনুযায়ী নির্বিচারে মালিকবিহীন প্রাণি নিধন বা অপসারণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচ্য এবং এই ধারার উপ-ধারা (২) অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০,০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
সারমেয়দের নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে একমাত্র বন্ধ্যাকরণই সেন্টমার্টিনে কুকুরের সংখ্যাধিক্য হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের টেকসই এবং বিজ্ঞানসম্মত সমাধান। পাশাপাশি কুকুরগুলোর দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব/মালিকানা প্রসারণ, সুষ্ঠু খাদ্যবর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অন্যত্র এডপশন প্রয়োজন। এজন্য আন্তর্জাতিক প্রাণিকল্যাণ স্ট্যান্ডার্ড মেনে সেন্টমার্টিন জীববৈচিত্র্য রক্ষার দায়িত্বশীল ভূমিকায় যেসকল স্টেকহোল্ডার কাজ করে, তাদের পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে যুগোপযোগী পদ্ধতিতে সেন্টমার্টিনে কুকুর বন্ধ্যাকরণ অত্যন্ত জরুরি।