
বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে চশমাপরা হনুমান ও মুখপোড়া হনুমান। বাংলাদেশে এই দুই প্রজাতির হনুমানের বিচরণক্ষেত্র সিলেট অঞ্চলের বনাঞ্চলে। বনাঞ্চল কমে যাওয়াতে এই দেশে ইতিমধ্যে ওই দুই প্রজাতির হনুমানের সংখ্যাও কমছে। তবে হনুমান নিয়ে গবেষণায় বাংলাদেশ ও জার্মান বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। গবেষণায় এই দুই প্রজাতির হনুমানের মধ্যে মিলেছে মিশ্র বা সংকর প্রজাতি। যা রীতিমত হতবাক করেছে বিজ্ঞানীদের।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বনাঞ্চল কমে যাওয়াতে দুই ভিন্ন প্রজাতির হনুমানেরা একে অপরের সঙ্গে মিলনে লিপ্ত হচ্ছে। এতে জন্ম নিচ্ছে সংকর প্রজাতির হনুমান। যা আগামীতে প্রকৃতিতে এই প্রাণীটির সংখ্যা কমে যেতে পারে। তাছাড়া বানর-হনুমান জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসী প্রজাতির বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে মাঠ পর্যায়ে পরিচালিত হয় হনামুনের ওপর এই গবেষণা। গবেষণাটি পরিচালনা করেন দেশের ১৫ জন গবেষক। এই দলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন জার্মান দুই জন প্রাণী বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিয়ান রোস এবং ড. ডিটমার জিনার। গবেষক দলটির নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও জার্মানীর গোটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক এবং জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষক তানভীর আহমেদ। সম্প্রতি এই নিয়ে স্প্রিঞ্জার নেচারের ইন্টারন্যাল জার্নাল অব প্রাইমাটোলজিতে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্র।

গবেষণাপত্রে যা বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা চশমাপরা হনুমান (বৈজ্ঞানিক নাম: ট্র্যাচইপিথেকাস ফেরেই) এবং মুখপোড়া হনুমানের (বৈজ্ঞানিক নাম: ট্র্যাচইপিথেকাস পিলেটুস) মিশ্র প্রজাতির দল এবং তাদের মধ্যে সংকর প্রজাতি সনাক্ত করা হয়েছে।
জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষকরা ছাড়াও ১৫ সদস্যের এই গবেষক দলে ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফার, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক মো: সাবিত হাসানসহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী, স্থানীয় ইকো-গাইড এবং বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রীরা এই গবেষণায় সহযোগিতা করেন। বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমতি পাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এতে আরও বলা হয়, হনুমানগুলো সংকর প্রজাতির কিনা তা নিশ্চিত হতে জার্মানীর গবেষণাগারে হনুমানের মলের ওপর জীনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালিত হয়। প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা- আইইউসিএনের লাল তালিকায় বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে চশমাপরা হনুমান। এদের বিস্তৃতি কেবলমাত্র বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে মিয়ানমারের ইরাবতী নদী পর্যন্ত।

অন্যদিকে মুখপোড়া হনুমান বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, মায়ানমার এবং চীনের সামান্য কিছু অঞ্চলে দেখা যায় মুখপোড়া হনুমান। বাংলাদেশের সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের বেশ কিছু পাহাড়ি বনে এই দুই হনুমান প্রজাতির বসবাস। এছাড়া মধুপুরের পত্রঝরা বনেও মুখপোড়া হনুমান আছে। তবে বাংলাদেশে তথা বিশ্বেই এই দুই প্রজাতির কি পরিমাণ হনুমান টিকে আছে তার স্পষ্ট তথ্য নেই।
চশমাপরা হনুমানের একটি দলে সাধারণত সর্বনিম্ন ৪টি থেকে ২৬টি পর্যন্ত হনুমান থাকে। আর মুখপোড়া হনুমানের দলে থাকে ৪ থেকে ১৭টি। উভয় প্রজাতিই মূলত বৃক্ষচারী প্রাণী এবং প্রয়োজনে মাটিতেও চলাফেরা করে। বন্য লতাপাতা, ফুল-ফল, কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার। এরা খাদ্য গ্রহণ ও মলের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা প্রাকৃতিকভাবে বনকে নতুন জীবন দান করে।
গবেষণার পটভূমি
গবেষকদের দলনেতা তানভীর আহমেদ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ‘১৯৯৭–৯৮ সালে রেমা-কালেঙ্গা বনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুল কবির পিএইচডি গবেষণার সময় সর্বপ্রথম চশমাপরা হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমানের দুইটি অস্থায়ী মিশ্র-প্রজাতির দল দেখেন। সেগুলোতে কোন সংকরেরও উপস্থিতি ছিল না। প্রায় ২০ বছর পরে ২০১৭ সালে আমরা প্রথমবারের মতো সাতছরি জাতীয় উদ্যানে একটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান দেখে বিস্মিত হই। ইতিপূর্বে এই দুই প্রজাতির হনুমান মিলে সংকর হনুমান জন্মদানের কোন বৈজ্ঞানিক ইতিহাস নেই।’

মিশ্র-প্রজাতির হনুমান দল ও সংকরায়ন
গবেষকরা জানান, মাঠ পর্যায়ে গবেষণার প্রথম ধাপে হিসেবে সিলেটের বিভাগের লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা, রাজকান্ধি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনে মোট ৯২ দিন হনুমান জরিপ করেন গবেষকরা। প্রায় চার বছর ধরে মিশ্র প্রজাতির হনুমানের দলগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। জরিপে মোট ৯৮টি হনুমানের দল দেখা গেছে। যাদের মধ্যে ৪১টি ছিল চশমাপরা হনুমানের দল, ৪৯টি মুখপোড়া হনুমানের দল এবং বাকি ৮টি মিশ্র-প্রজাতির হনুমানের দল।
গবেষক তানভীর আহমেদ জানান, তিনটি মিশ্র দলে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তিনটি সম্ভাব্য সংকর হনুমানও চিহ্নিত করা হয়। যেগুলোর দুটি দেখা যায় সাতছরি জাতীয় উদ্যানে এবং একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। সম্ভাব্য সংকরগুলোর মধ্যে প্রথম হনুমানটি ছিল পূর্ণবয়স্ক মহিলা। যার স্তনের আকার এবং লম্বাটে বোঁটার ধরণ থেকে সহজেই অনুমেয় যে সেটির বাচ্চাও ছিল এবং বাচ্চা নিয়মিত দুধ পান করত। বাকি দুটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান অপ্রাপ্তবয়স্ক। তবে সংকরায়ন নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় হল সম্ভাব্য সংকরের জীনগত পরীক্ষা করা। তাই সংকরায়ন নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে সংগৃহীত মলের নমুনার জীনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় জার্মানির জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষণাগারে।
গবেষণায় এক যুগান্তকারী তথ্য উঠে এসেছে যে- ২০২৩ সালে উল্লেখ করে এই গবেষকর বলেন, সাতছড়ির একটি মিশ্র দলে জন্মানো সম্ভাব্য সংকর হনুমানের বাবা আসলে চশমাপরা হনুমান এবং মা মুখপোড়া হনুমান। এই ফলাফলের তাৎপর্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সংকর হনুমানের উপস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এটি ইঙ্গিত দেয় যে এই দুই বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক প্রবাহ তাদের ভবিষ্যত জেনেটিক গঠনে অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতে পারে।’
যে কারণে বিরল ও প্রাকৃতিক ঘটনা
গবেষকরা বলছেন, সংকরায়ন একটি বিরল কিন্তু প্রাকৃতিক ঘটনা। যা সাধারণত দুই প্রজাতির বিস্তৃতির মিলনস্থলে ঘটে। অনেক প্রজাতির প্রাণিতে এই ধরণের সংকর দেখা গেছে। সংকরায়ন প্রাণীর বিবর্তন প্রক্রিয়া এবং শ্রেণিবিন্যাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। তবে মানবসৃষ্ট নানা ক্রিয়াকলাপ যেমন বন ধ্বংস, বড় বন ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ হওয়া, অবৈধ শিকার ও বাণিজ্যের কারণে প্রকৃতিতে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়া এবং নানা আগ্রাসী প্রজাতির মুক্তি বানর-হনুমান জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে সংকরায়ন ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার বেশ কিছু হনুমান প্রজাতিতে এ ধারা দেখা যাচ্ছে।
জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিয়ান রোস বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “এটি শুধুমাত্র একটি স্থানীয় সমস্যা নয়— একটি বৃহত্তর এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের অংশও। যখন আবাসস্থলগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, প্রাণীরা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যা প্রাকৃতিকভাবে ঘটতো না। ফলে সেখানে সংকরায়ন ঘটতে পারে। যা এক বা উভয় প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।”
গবেষণায় আরও দেখা যায়, লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে হনুমানের ঘনত্ব রাজকান্ধি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনের তুলনায় অনেক বেশি। যদিও দেশের সুরক্ষিত বনগুলো আকারে ছোট এবং একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে প্রাণীগুলো দিন দিন নির্দিষ্ট অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং জীনগত আদান-প্রদানের সুযোগ কমে যাচ্ছে। তাই গবেষণায় বাংলাদেশের বন সংরক্ষণনীতি আরও শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়েছেন গবেষকরা।

ছবি: মাহমুদুল বারী
জরিপের সময় সিলেট বিভাগে প্রায় ৫০০ চশমাপরা হনুমান এবং ৬০০ মুখপোড়া হনুমান দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষক দলের সদস্যরা। তারা বলেন, হনুমানের আবাস্থল ক্রমবর্ধমান মানবসৃষ্ট কারণ- যেমন বনের জমি বেদখল করে বাড়িঘর নির্মাণ, কৃষিকাজ, কাষ্ঠল উদ্ভিদের চাষাবাদ, গাছ চুরি, এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। তাছাড়া বন্যপ্রাণীর অবৈধ শিকার-বাণিজ্য, বিদ্যুতস্পৃষ্ট ও গাড়ি চাপায় মারা যাওয়াসহ নানা কারণে হনুমানগুলোর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। তাই বিপন্ন এই প্রাণীগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়াসহ বন সংরক্ষণ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য করিডোর তৈরির করার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।
তানভীর আহমেদ জোর দিয়ে বলেন, ‘বন সংরক্ষণ অবশ্যই একটি জাতীয় অগ্রাধিকারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যদি আমরা এখনই প্রাণীদের এসব আবাসস্থলগুলো রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ না নিই তবে আমরা শুধুমাত্র দুটি প্রজাতির হনুমানই হারাবই না, বাংলাদেশের অমূল্য জীববৈচিত্র্যের একটি অংশও হারিয়ে ফেরবো।’
গবেষণার সহ-গবেষক ড. ডিটমার জিনার বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, হনুমানগুলোর ওপর সংকরায়নের জীনগত প্রভাব বোঝা এবং সংরক্ষণ কৌশল ঠিক করার জন্য অবশিষ্ট হনুমানগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সংকর হনুমানের উপর গভীর গবেষণা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণার ফলাফল একটি সতর্কবার্তা, এটি কেবল শুরু। ‘
তিনি বলেন, ‘বিপন্ন হনুমানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ কৌশল তৈরির জন্য আমাদের আরও তত্থ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। সংকরায়নের বিস্তৃতি, মানুষের ক্রিয়াকলাপের সাথে সম্পর্ক এবং এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।’