
সুন্দরবনকে অনেকেই নানারকম বিশেষণে বিশেষায়িত করেছেন। আমরা বলি সুন্দরবন হলো- আনপেডিকটেবল ফরেস্ট; যদিও বাংলা অনুবাদে ইংরেজি এই শব্দের ভাব পুরোপুরি আসে না। এই বনের পরিবেশ-প্রকৃতি-আবহাওয়া-জীববৈচিত্র্য কিংবা সাগর-নদী-সায়রের আচার-আচরণ সবই প্রত্যাশার বিপরীতে কাজ করে।
গত ৩১ মার্চ ২০২২, আমরা ঠিক সেভাবেই সুন্দরবনের একটি খালের পাড়ে অপ্রত্যাশিতভাবেই একটি গাছের ডালে বহু বছরের বহু দিনের প্রত্যাশিত বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘকে পেয়ে যাই। সত্যিই এটাও একটি আনপেডিকটেবল ইন্সিডেন্ট বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। বাঘকে সাধারণত হুদোবনে শ্বাসমূলের মধ্যে, ডাঙায়, কাঁদামাটিতে কিংবা পানিতে পাওয়া যাবে- এটাই স্বাভাবিক। আমরা পেলাম গাছের ডালে- এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
আমাদের এবারের দলে সাতজন ছিলাম, যারা অনেকদিন ধরেই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করি। আমি, আমাদের কিসমত ভাই, এমদাদুল ইসলাম বিটু ভাই, আদনান আজাদ, আদনান হোসেন সম্রাট, ফরিদপুর থেকে জয়েন করেন ডা. সাইফুল আলম, শেরপুর থেকে মুগনিউর রহমান মণি। এছাড়া হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে জয়েন করেছিলেন মোমিনুল হক এবং দেওয়ান ফরহাদ। মোমিন ভাই আগে একবার সুন্দরবন এলেও ফরহাদ ভাই জীবনে এবারই প্রথম সুন্দরবনে এসেছেন।
মার্চের ২৯ তারিখ সূর্য ওঠার আগেই মোংলা থেকে ফেমাস ট্যুরস বিডি-ভ্রমণ বাংলা’র আয়োজনে তাদের লঞ্চ গাংচিলে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে এমাসে বেশ কয়েকটি স্থানে বাঘ দেখা গিয়েছিলো সেসব স্থান দিয়ে খুব ধীর গতিতে বা কখনো থেমে থেমে আমরা বাঘ খুঁজতে থাকি। দ্বিতীয় দিনও ঠিক এভাবেই পার হলো। এদিন কচিখালীর পাশে ডিমের চরে বড় মোটাহাঁটু, মদনটাক আর বড় উদবিড়াল পেলাম।
তৃতীয় দিন সূর্য ওঠার সাথে সাথে একটি সিন্ধু-ঈগল আমাদেরকে স্বাগত জানালো। আমাদের খুব কাছে খানিক ওড়াউড়ি করে ক্যামেরার সাটার গরম করলো। এরপর জামতলা খালে ঢুকে একে এক তিনটে গোখরা সাপ ছাড়াও রামগুই, ঝুটিয়াল শিকরে ঈগল, সুন্দরবনের অতি পরিচিত খয়রাপাখ মাছরাঙা, কালাটুপি মাছরাঙা, ছোট সাহেলিসহ আরো কিছু পাখি বা প্রাণীর সাথে দেখা হলো। জামতলা জেটিতে নেমে বনের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে হলো- যদি মামার দেখা পাই!
চৈত্র মাসের শরীর পোড়ানো গরম, মাথার সূর্য আর তপ্ত মাটি- সবমিলে সবার অবস্থা কাহিল। সকালে কারো নাস্তাও হয়নি, পানির বোতলগুলোও খালি হয়ে গেছে। জামতলা হেঁটে তেমন কিছু না পেলেও উপমহাদেশের দুর্লভ বড়েঠোঁট নলফুটকি পাখিটিকে পেয়েছিলাম। চৈত্রের তপ্ত-তাওয়ায় ভাজা হতে হতে আর সমুদ্রের মোহনায় সুপতি গাংয়ে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের নাগরদোলায় চড়ে বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা লঞ্চে ফিরে আসি।

লঞ্চে ফিরেই হাপুস-হুপুস নাস্তা সারলাম সবাই। ব্যস প্রায় সবার শরীরেই ক্লান্তি ভর করলো। দু’একজন ছাড়া প্রায় সবাই লঞ্চের কেবিনে কিংবা চিপা-চাপায় যে যেখানে পারলো ঘুমিয়ে পড়লো। সাইফুল ভাই তার কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে আমাকে বলেই ফেললেন, বিকেলে অফিস পাড়ায় যাওয়ার জন্য তাকে যেনো ডাকা না হয়। এমনিতেই কিসমত ভাইর পায়ে রিং পরানো, তিনি কিছু না বললেও বুঝলাম তার অবস্থাও কাহিল।
এরমধ্যে সমুদ্র থেকে উত্তাল তরঙ্গ সুপতি নদীতে ভেসে থাকা আমাদের ছোট্ট লঞ্চ গাংচিলকে দুলিয়ে দুলিয়ে খেলতে শুরু করেছে। আমাদের তরুণ সারেং এনামুল লঞ্চটিকে ভাটির দিয়ে নিয়ে চলতে লাগলো উত্তাল ঢেউয়ের কাছ থেকে রক্ষা পেতে। অন্তত ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর একটা বড় খালের মাঝে সে নোঙর ফেললো। কটকা’র অফিস পাড়ায় বিকেলের পরিকল্পনা বাতিল করে আমরা যেখানে নোঙর করেছি সেখানকার আশে-পাশে ইঞ্জিন নৌকায় ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা নিলাম। তাতে অতি ক্লান্তজনরাও আমাদের সাথে যেতে পারবে।
বিকেল তিনটার পর আমরা সবাই ইঞ্জিন নৌকায় চেপে বসলাম। লঞ্চে আমরা যত হই-চই করিনা কেনো, নৌকায় বসলে সবাই একেবারে চুপচাপ। কোনকিছু নজরে এলে ইশারায় কথা বলতে হয়। কিছুদূর যাওয়ার পর হাতের বামে একটি শাখা খালে ঢুকলাম আমরা। এবার নৌকার ইঞ্জিনও বন্ধ করে দিতে হলো। মাঝি হাতের বৈঠা দিয়ে নৌকা বাইছে। তখন বৈঠার ছপ ছপ শব্দ, কিছু পাখির কুজন আর আমাদের ক্যামেরার সাটারের শব্দ ছাড়া মনে হলো পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই। এই শাখা খালে আমরা কয়েকটি পাখি পেলাম বটে, সেগুলো আমাদের কাছে নতুন কিছু না। তাই সেখান থেকে ফিরে চললাম।
বড় খালে এসে ফের নৌকার ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়া হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর হাতের বামে আরো একটি খাল দেখলাম। কিন্তু খালটি বেশি সরু আর পানি কম মনে হওয়ায় খালটিতে আর ঢোকা হলো না। সময় তখন বিকেল চারটা বেজে চৌচল্লিশ মিনিট। বড় খালটির পশ্চিম পাশ ধরেই আমাদের ইঞ্জিন নৌকাটি চলছিলো। হঠাৎ কেওড়া গাছের পাতার ফাঁকে বাঘের মতো হলুদ রঙের বড় কিছু একটা দেখতে পেলাম।
ওটা কি বাঘ? নাকি বাঘের মতো কেউ? ব্যাপার বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিচ্ছিলাম। প্রায় একই সময়ে আমাদের এই ট্রিপের আয়োজক রুবেল ভাই অস্ফূট চিৎকার করে উঠলেন… বাঘ বাঘ বাঘ। হঠাৎ নৌকার মধ্যে তীব্র বিদ্যুৎধারা বয়ে গেলো। মুহুর্তের মধ্যে সবাই চমকে গেলো। কিন্তু কোথায় বাঘ? যারা তখনো বাঘটিকে দেখেননি, তারা মাটিতে কিংবা পানিতে বাঘ খুঁজতে লাগলো। যে ছেলেটা বোট চালাচ্ছিলো সেও তখনো বাঘটিকে দেখে নাই। বাঘটি ছিলো অনেকগুলো কেওড়া গাছের মাঝে পানিতে এলিয়ে পড়া একটি সোমত্ত বাইন গাছের উপর বসা।
আমাদের নৌকাটি সেই বাইন গাছের নিচে চলে গিয়েছিলো প্রায়, আর বাঘটিও বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। জোরে লেজ নেড়ে সেও আমাদেরকে সতর্ক করছিলো। রুবেল চিৎকার করে বোট চালকেকে যখন সতর্ক করলো, নৌকাটিকে হঠাৎ ঘুরিয়ে নেয়ার পর সবাই দেখলো সামনে আমাদের অনেকদিনের প্রত্যাশিত বেঙ্গল টাইগার।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুন্দরবনের আদরের রাজপুত্তুর বেঙ্গল টাইগার শান্ত হয়ে বাইন গাছের একটি বাকানো ডালকে সিথান বানিয়ে সেখানে মাথা রেখে আমাদের দেখছিলো, আর অনবরত তার লম্বা লেজটিকে দুলিয়ে যাচ্ছিলো। অসম্ভব আদুরে চেহারার এক আহ্লাদী ভঙ্গিমা তার। মনে হচ্ছিলো বাড়ির পোষা বিড়াল। তার শরীর পরিস্কার ঝকঝকে, একটুও কাঁদা নেই। মনে হচ্ছিলো সাবান-শ্যাম্পু মেখে গোসল করে আমাদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে বলে সেজে-গুজে এসেছে। তার অভিব্যক্তিতে আমাদের কারোর মনে একটু ভয় কাজ করেনি।
সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো বাঘের মুখোমুখি হয়ে কি অনুভূতি হয়েছিলো তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। ক্যামেরার সেটিং ঠিক ছিলো কিনা তা দেখা হয়নি, অনবরত মেশিনগানের মতো কন্টিনিউয়াস মুডে সবাই সাটার চেপে চলেছি। নৌকা চালককে ইঞ্জিন বন্ধ করতে মানা করে শুধু বাঘটিকে কেন্দ্র করে যাওয়া-আসা করতে বলা হয়েছে। বাঘের চোখে চোখ রেখে ক্লোজ বা বিগ ক্লোজ অথবা লং শটে ছবি তুলেছে সবাই। প্রায় এক ঘন্টা ধরে কমপক্ষে এক হাজার থেকে তিন হাজার ছবি তুলেছি একেক জন। একজনের তো ক্যামেরার কার্ড ফুরিয়ে গেছে, আরেকজন পুরনো একটি কার্ড বার বার ফরমেট দিচ্ছে, কিন্তু ক্যামেরা ফরমেট নিচ্ছে না। কেউ কেউ ভিডিও করেছে। কেউ কেউ মোবাইলেও ছবি তুলেছে।
বাঘের সাথে সেলফি তোলার দুর্লভ সুযোগও নিয়েছেন কেউ কেউ। ইতিমধ্যে সূর্য জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে সাঁঝের আঁধারের কাছে দিনকে সমর্পণ করেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসায় আলোক স্বল্পতায় আমাদের ক্যামেরার সাটারের স্পীড কমে গেছে। ভালো ছবি হবে না বিধায় আমরা আমাদের লঞ্চে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। পেছনে তখনো বসে থাকলো আমাদের সকলের আদরের প্রিয় বেঙ্গল টাইগার, বাংলা বাঘ।
এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, খুব সচেতনভাবেই বিকেলে আমরা যে অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করছি এবং বাঘের ছবি তুলেছি, সেই লোকেশনের কথা খোলাখুলি বা পরিষ্কার করে বলছি না। এই নির্দেশনা আমাদের টিমের সমস্ত সদস্যকেই দেয়া হয়েছে। এর দুটি কারণ। প্রথমত: এটি ছিলো একটি কিশোর বয়সী বাঘ। জায়গাটি প্রকাশিত হলে এখানে পর্যটকসহ নানা ধরণের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এতে বাঘটির উপর একরকম উপদ্রব হতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টি ভয়াবহ। সুন্দরবনে নানা ধরণের চোরা শিকারী আছে, তারাও তৎপর হয়ে উঠতে পারে। এতে বাঘটি নিরাপত্তা হুমকীতে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের যতগুলো ছবি আছে, আমি নিশ্চিত আমাদের তোলা ছবিগুলো তারমধ্যে সুন্দরতম ছবি। আমরা ছবি তোলার পাশাপাশি বন্যপ্রাণী এবং তার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতার দায়ে সবাইকে সচেতন করতে চাই। ভালো থাকুক আমাদের সবগুলো বন এবং বনের প্রাণী।