বাংলাদেশে পাখি বা প্রজাপতির মতো বন্য মাছ নিয়ে আগ্রহী মানুষ এতো অল্প কেন, তা এক বড় প্রশ্ন! অনেকেই জানেনই না এ দেশে আছে মাছের নানা বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্য অসামান্য, অনিন্দ্য। ছবির মাছটি নিশ্চিতভাবেই অধিকাংশ মানুষই চেনেন না!
বাংলা নাম কাঠখলিসা। ইংরেজিতে হানি গোরামি/Honey Gourami; বৈজ্ঞানিক নাম- ত্রিচগাস্টার চুনা/Trichogaster chuna বলা হয়। অবশ্য চুনা নামটা এসেছে এদের বাংলা নাম চুনা খইলসা থেকে। কোথাও কাঠ খলিসাও বলে। মৌ খলিসা নামটা পাওয়া নওগাঁর তালতলি বিল অঞ্চল থেকে, এটা ইংরেজির বাংলা অনুবাদ না। আসলেই এদের পুরুষ মাছটির প্রজনন রঙ চাকভাঙা মধুর মত। এ দেশের আর কোন মাছের এই নির্দিষ্ট কমলা মধুর রঙটি নেই; এদিক থেকে এরা অনন্য।
একটি শালবনের ভেতরে আদিবাসী ডোবা থেকে সংগ্রহ করা এ মাছগুলো চোখে দেখাও ভাগ্যের ব্যাপার। একবারে মধুর মতো রঙ, বুকটা কালচে আকাশী, পিঠ-পাখনা সোনালি। যদিও নারী মাছ তেমন সুন্দর না। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ এবং নারী মাছ একবারেই আলাদা। দেখে দুটি আলাদা খলিসা মনে হবে তখন।
খুব মজার বিষয় এদের পুরুষের এই রঙ শুধু প্রজনন মৌসুমের। এজন্য বাংলাদেশে কাজ হওয়া মৃত প্রজাতিতে এই রঙ দেখা অসম্ভব। এদের এই সৌন্দর্য দেখতে আপনাকে তার জীবন্ত আনন্দের মুহূর্ত দেখতে হবে, তাদের ব্রিডিং ডান্স, তাদের কোর্টশিপ তাদের সংসার করা বাচ্চা ফুটানো… ছোট্ট ছোট্ট পোনাগুলোর বড় হওয়া।
বাংলাদেশে ভালো নেই মৌ খলিসারা
মূল কারণ পানির গুণগত মানের বিপর্যয়। খলিসা সবগুলি প্রজাতি পরিষ্কার পানি পছন্দ করে। দেশের জলাশয় যে হারে দূষন হচ্ছে এতে অন্তত সবচেয়ে সেন্সিটিভ মৌ খলিসার পক্ষে প্রজনন অসম্ভব। আরেক কারণ সাকার ফিশের মতো আরেক ইনভ্যাসিভ স্পেসিজ/আক্রমণাত্মক প্রজাতি ক্র্যাকিং গোঁড়ামি/croaking gourami’র এদের জায়গা দখল করে নেয়া। মৌ খলিসা আগেও কম ছিল, এখন অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নদী দূষণ আর আবাসস্থল হারানো প্রতিযোগিতায় হেরে একেবারেই বিলুপ্তির মুখে মাছটি।
মৌ খালাসি প্রজনন খাল-বিল নদী-নালা অর্থাৎ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে না দিতে পারলে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রায় নিশ্চিতভাবেই ডাইনোসর কিংবা ডোডোপাখির মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এবং তখন দোকানে কিনতেও পাওয়া যাবে না, বিদেশ থেকে আমদানি করেও পালার সে আশাও প্রায় নেই, কারণ এদের মূল আবাস মূলত বাংলাদেশ, পাশাপাশি ভারতের কিছু অঞ্চল ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও নেই। নেপালে অসমর্থিত রেকর্ডের খবর আছে, তাও খুব অপ্রতুল।
বাংলাদেশে যে ভয়াবহ কীটনাশক, রাসায়নিক সার আর কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হয়, এতে এই অসম্ভব সেন্সিটিভ মাছগুলো বেচে থাকতে পারেনা। এখনি এই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে মলা, পুটি, শোল ও টাকি ছাড়া আর কোন মাছই দেখা যাবে না। আশার কথা, এদের কৃত্রিম প্রজনন হচ্ছে বিভিন্ন উন্নত দেশে। কখনো এই নিজস্ব মাছটিকে হয়ত শুধু বিদেশ বিভূঁইয়ের জলবাগানগুলোতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে হবে, আমরা কি হারিয়েছি!