দূষিত বায়ুতে ঢাকা নভেম্বর!

ঢাকায় বায়ু দূষণের চিত্র। ফাইল ছবি

ভোরের দিকে শিশিরকণা ঝরলেও সকাল হতেই রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ধুলাবালি। এ যেন দূষণে এলো শীতের আমেজ! অন্যান্য বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় গত অক্টোবরে বায়ুদূষণ ছিল বেশি। আর নভেম্বরের শুরু থেকেই প্রতিদিন ‘অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় থাকছে ঢাকার বায়ুমান। ফলে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে ঢাকা।

সোমবার (২০ নভেম্বর) সকাল সাড়ে আটটার দিকে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল চতুর্থ। আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে এ সময় ঢাকার স্কোর ছিল ১৭৩ একিউআই। বাতাসের এ মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গতকাল রোববার ঢাকার স্থান ছিল সপ্তম আর স্কোর ছিল ১৭১। দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারতের দিল্লি ও পাকিস্তানের লাহোর। শহর দুটির স্কোর যথাক্রমে ২৬৯ ও ২৪৫।

গত ৭ নভেম্বর সকাল ৯টা থেকে ১০ পর্যন্ত বায়ুদূষণে বিশ্বের ১১০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ৫ম। এ সময় ঢাকার বায়ুমান ছিল ১৮২ একিউআই। বাতাসের এ মানকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বিবেচনা করা হয়। এর আগের দিন সোমবার একই সময়ে ঢাকার বায়ুমান ছিল ১৯৬ একিউআই। এমনকি এদিন রাত ৮টার দিকেও ঢাকার বায়ুমান ছিল ১৭৪ একিউআই।

দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় গতকাল প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারতের দিল্লি ও পাকিস্তানের লাহোর। শহর দুটির স্কোর যথাক্রমে ৩৪২ ও ৩১৭। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুদূষণ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান আইকিউ-এয়ার জানায়, মঙ্গলবার ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণায় (পিএম ২.৫) দূষণের মাত্রা বেশি ছিল, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ২৩ গুণ বেশি।

কী বলছে আইকিউএয়ার

বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এ লাইভ বা তাৎক্ষণিক একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। আইকিউএয়ারের দেওয়া আজকের তালিকায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। ঢাকার বাতাসে যতটা এই বস্তুকণা আছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে ২১ গুণের বেশি। বাতাসের এ অবস্থা থাকায় সবার জন্য পরামর্শ, বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

বায়ুদূষণ বেশি হলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন সংবেদনশীল গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা। তাদের মধ্যে আছেন বয়স্ক, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও জটিল রোগে ভোগা ব্যক্তিরা। তাঁদের বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হওয়া দরকার বলে পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়। ঢাকায় গত জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বাতাসের মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। জানুয়ারির মোট ৯ দিন রাজধানীর বাতাসের মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

গবেষণা যা বলছে

২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের দেওয়া আট বছরের বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণা থেকে পাওয়া ফল বিশ্লেষণের পর দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছিল। যার ধারাবাহিকতা ২০২৩ সালেও দেখা গেছে। ২০২১ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৫৯.০৮ ও ২০২২ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৬২.৮৪ এবং ২০২৩ সালের ১০ মাসের গড় বায়ুমান সূচক ১৬৫। আবার সবচেয়ে কম গড় বায়ুমান সূচক পাওয়া যায় ২০১৭ এবং ২০২০ সালে ১৪৬.০৯ ও ১৪৩.৩৭। ২০২০ সালে কোভিড লকডাউনের কারণে বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধ থাকায় দূষণের পরিমাণ কম দেখা গেছে।

ক্যাপসের গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত (২০২২ ছাড়া) প্রতিবছরই জানুয়ারি মাসে গড় বায়ুমান সূচক ছিল সর্বোচ্চ ২৪৮.২৪ একিউআই। আর সর্বনিম্ন মানগুলো পাওয়া যায় জুলাইয়ে ৮৯ এবং আগস্টে ৯৮ একিউআই। গত ৮ বছরের তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসের গড় বায়ুয়ান সূচক ২৪৮.২৪ একিউআই, আর নভেম্বরে ১৭৪.৫২ একিউআই ও ডিসেম্বরে ২৪৯.৩৫ এবং ফেব্রুয়ারিতে ২২২.৩৯ একিউআই। যা সারা বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় দূষণের পরিমাণ বেশি ছিল।

২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল (২০১৮ ছাড়া) পর্যন্ত গত ৭ বছরের বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ক্যাপস। এতে দেখা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবর মাসের বায়ুদূষণ আগের ৬ বছরের অক্টোবর মাসের তুলনায় শতকরা ১৬.৪৪ ভাগ বেশি ছিল। আর ঢাকায় বায়ুমান সূচক আগের ৭ বছরের (২০১৬-২২) অক্টোবর মাসের গড় মান ১৩১.৬৩ একিউআইয়ের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবর মাসে শতকরা প্রায় ১৬.৪৪ ভাগ বেড়েছে। আর ২০২২ সালের তুলনায় চলতি বছর বায়ুমান সূচক শতকরা ১৬.৩৭ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ ছাড়া গত ৭ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে ঢাকায় অক্টোবর মাসের বায়ুমান সূচক গড়ে ছিল ১৩২.৫ একিউআই, ২০১৭ সালে ১১৫, ২০১৯ সালে ১৩১, ২০২০ সালে ১২৮, ২০২১ সালে ১৫২ একিউআই ছিল। আর ২০২২ সালের বায়ুমান সূচক ২০২১ সালের তুলনায় কমে গড়ে ১৩১.৭ একিউআইতে এসে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বায়ুমান সূচক বেড়ে ১৫৩.২৬ একিউআই হয়েছে।

চলতি বছর অক্টোবর মাসে ঢাকার বায়ুমান এক দিনও ভালো (০-৫০ একিউআই) ছিল না, মধ্যম (৫১-১০০ একিউআই) ছিল ৬ দিন, সতর্কতা (১০১-১৫০ একিউআই) ছিল ৪ দিন। আর অস্বাস্থ্যকর (১৫১-২০০ একিউআই) ছিল ২০ দিন ও খুব অস্বাস্থ্যকর (২০১-৩০০ একিউআই) ছিল এক দিন। ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, গত ৭ বছরের অক্টোবর মাসের মধ্যে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। আর গত ৭ বছরের অক্টোবর মাসের ২১৪ দিনের মধ্যে ৮৮ দিন ছিল ‘সতর্কতামূলক’ এবং মোট ‘অস্বাস্থ্যকর’ ৮৯ দিনের মধ্যে ২১ দিনই ২০২১ সালে অবস্থিত ছিল।

গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই ধুলাবালিতে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো। রাজধানীর রামপুরা ব্রিজের মুখ থেকে হাতিরঝিল সড়কে দেখা গেল, খুঁড়ে রাখা রাস্তার ধুলাবালিতে ঢেকে গেছে পুরো এলাকা। গাড়ির চাকা থেকে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ছে ধুলাবালি। এতে পথচারীদের অবস্থা বেগতিক। ধুলায় আক্রান্ত অনেককে হাঁচি-কাশি দিতেও দেখা যায়। শুধু এই এলাকাই নয়, গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর কাওরান বাজার, শাহবাগ, ধানমন্ডি, মহাখালী, তেজগাঁও, বনানী, উত্তরা, নতুনবাজার এবং বাড্ডা এলাকা ঘুরেও এমন চিত্র দেখা গেছে। ধুলাবালির সঙ্গে বিভিন্ন গণপরিবহনের কালোধোঁয়াও ছিল চোখে পড়ার মতো। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় বায়ুদূষণের জন্য উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী করা হচ্ছিল। তবে এখন সেসব কর্মকাণ্ড প্রায়ই শেষ পর্যায়ে। তবুও কেন কমছে না বায়ুদূষণ?

যে কারণে কমছে না দূষণ

ক্যাপসের গবেষণা বলছে, চলতি বছরের ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসই গত সাত বছরের চেয়ে বেশি ছিল বায়ুদূষণ। রেকর্ড বায়ুদূষণে রয়েছে ঢাকা। আগামী তিন মাস এ ধারাবাহিকতা থাকলে তা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া এতদিন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণ হলেও এখন ধরন বদলেছে বলেও জানান গবেষকরা। তারা বলছেন, ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় সেখানে উঠতে গিয়ে বায়ুদূষণ হচ্ছে। অর্থাৎ ৪৫ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে গাড়িগুলোকে পাহাড়সম ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে হচ্ছে। ওঠার জন্য পুরোনো যাত্রীবাহী গাড়িগুলো উপযুক্ত নয়। কারণ এগুলো তো পাহাড়ে চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। কিন্তু সেগুলোকে উপরে উঠতে হচ্ছে, ফলে এগুলো থেকে ধোঁয়ার দূষণও বেশি হচ্ছে। একই সঙ্গে সড়কের ধুলাবালিও গাড়ির সঙ্গে উপরের দিকে উঠছে, যা দূষণের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে রাজধানীর মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

চিকিৎসকদের পরামর্শ

শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, একদিকে ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুম এলেই ধুলাবালির প্রকোপ বেড়ে যায়। গত কয়েক দিন ধরে বায়ুদূষণজনিত রোগ ও সমস্যা নিয়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শীত মৌসুম ও ধুলাবালির কারণে সিওপিডি, অ্যাজমা, কাশি ও নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাদের বেশিরভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। তাই বায়ুদূষণজনিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার, ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাসহ ধুলাবালি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

প্রয়োজনে দরজা-জানালা বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, শিশু ও বৃদ্ধদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় বায়ুদূষণের কারণে ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসে প্রদাহ, নিউমোনিয়াসহ ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ থেকে শহরবাসীকে রক্ষা করতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। না হলে আগামীতে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।