আসুন বাঘ সংরক্ষণে সরকারের সহযোগী হই

মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃক্ষ ও বন-বনানি থাকা অত্যাবশ্যক। উপকূলীয় বন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ বিপর্যয়কর ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়। সুন্দরবন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। অন্যদিকে, ‘বেঙ্গল টাইগার’ সুন্দরবনের রক্ষক।

হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা অভিজাত প্রজাতির এ বাঘের উপস্থিতির কারণেই সুন্দরবন এত বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়। সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার না থাকলে সেখানকার সামগ্রিক প্রতিবেশ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সুন্দরবনকে বাঁচাতে বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া প্রভৃতি পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখন বাঘের অস্তিত্ব আছে। বাঘ বাঁচাতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বাঘ সমৃদ্ধ দেশগুলোর সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ সমৃদ্ধ ১৩টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমকে গতিশীল করতে প্রতিবছর ২৯ জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস পালিত হচ্ছে। বাঘের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা এবং এর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ও ভয় দূরীকরণ সর্বোপরি বাঘ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে এ দিবস পালন করা হয়। ‘বাঘ বাঁচায় সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচায় লক্ষ জীবন’ প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশেও ২৯ জুলাই বাঘ দিবস ২০২১ পালন করা হবে।

বাঘের বসবাস উপযোগী নিরাপদ বনাঞ্চল ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস, চোরাশিকারিদের কারবার, প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব, বাঘ ও মানুষের দ্বন্দ্ব, বনের অভ্যন্তরে অবাধে নৌ চলাচল, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বনের পাশে শিল্পকারখানা স্থাপন, বিভিন্ন ধরনের রোগ, বনে পর্যটকদের আনাগোনা, বাঘ শিকারিদের শাস্তির অভাব ইত্যাদি কারণে বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে বন্য বাঘের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ৯০০টি। বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বব্যাপী বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার এই প্রবণতা চলমান থাকলে আগামী কয়েক দশকে পৃথিবী থেকে বাঘ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে বাঘের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য আবাসস্থলের উন্নয়ন ও নিয়মিত টহল প্রদান করে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য যথোপোযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উভয় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ, বাঘ ও শিকারি প্রাণী পাচার বন্ধ, দক্ষতা বৃদ্ধি, মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালে একটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ১৪-১৬ তারিখ বাংলাদেশ সরকার ২য় স্টকটেকিং সম্মেলন আয়োজন করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন।

বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে বেঙ্গল টাইগার। ছবি: সংগৃহীত

বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধে ২০১৬ সালের ২৬-২৭ অক্টোবর ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার এর আয়োজনে ‘সাউথ এশিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক’ এর ৩য় বার্ষিক সভায় অনুষ্ঠিত হয়। বাঘ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ টাইগার একশন প্ল্যান ২০১৮-২০২৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ ও বংশবিস্তারের লক্ষ্যে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বনদস্যুর সাথে সংগ্রাম করে সুন্দরবন ও এর বাঘ রক্ষায় কাজ করে যাওয়া মাঠ পর্যায়ের বনকর্মীদের কাজে উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা প্রদান করছে। সুন্দরবন ও বাঘ সংরক্ষণের জন্য বনের চারটি রেঞ্জে জিপিএসের সাহায্যে নিয়মিত স্মার্ট পেট্রলিং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার প্রতিরোধে বন বিভাগের সাথে পুলিশ, র‍্যাব, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশ সমন্বিতভাবে কাজ করছে সুন্দরবনে।

মানুষ-বাঘ দ্বন্দ্ব নিরসনে ২০০৮ সালে সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামে ৪৯টি ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে। ফলে লোকালয়ে বাঘ আসা মাত্র খবরাখবর আদান-প্রদান ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। ২০১০ সালে ‘কমিউনিটি পেট্রল টিম’ ও ‘কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটি’ গঠন করা হয়। এই দলগুলোর সমন্বয়ে নিয়মিতভাবে পেট্রলিং ও তথ্য আদান-প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সুন্দরবন ও বাঘ সংরক্ষণে বন অধিদপ্তরের কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ বিষয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে।

লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ।
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।