হাতি লইয়া আমরা কী করিবো?

‘হাতি লইয়া আমরা কী করিবো’ এই প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে! কেননা প্রশ্নটি ভুলে থাকাই রেওয়াজ। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে এলিফ্যান্ট ইন দ্যা রুম (Elephant in the room)। এর মানে হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ বা বড় কোন ইস্যু যার আলোচনা কারো কারো জন্য অস্বস্তিদায়ক, তাই সকলেই জেনে বুঝেই এটা চেপে যান।

আলোচনায় অস্বস্তিকর বিষয়ের অবতারণা হলে বিব্রত হবার রেওয়াজ আছে। হোমড়াচোমরা কেউ বিব্রত হলে আলোচনা থেমে যায়, সমস্যা সমাধানের সুযোগ থাকে না। সমস্যাটি কই যায়? সমস্যা রেখে চোখ বন্ধ করলে সমস্যা গায়েব হয়ে যায়?… না। সমস্যার ডাল-পালা গজায়, নানান দিকে সমস্যা গড়ায়। নদী নালা খাল-বিল দখল করলে যেমন জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাজের সবার হয়ে দাঁড়ায় তেমন।

তবে বেচারা হাতি নিজেই যখন সমস্যা তখন ‘হাতি লইয়া আমরা কী করিবো?’ এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে চাইবে কিনা সন্দেহ! এ যে সত্যিকারের ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্যা রুম’ পরিস্থিতি! ভয়াবহ নীরবতাই ভাল। তাই চলছে! হাতি মরে না কেন? হাতি সংরক্ষণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের হাতির আবাসস্থল সংরক্ষণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বালিতে মুখ গুঁজে থাকতে দেখেছি। পরামর্শক ফি না পেলে মতামত দেয়ার চেয়ে বিব্রত হওয়াই শ্রেয় মনে করেন ওসব বিশেষজ্ঞগণ।

আবার কিছু বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ বন্যপ্রাণীকে প্রদর্শনীযোগ্য করতেই ব্যস্ত থাকেন। পারলে তাবৎ বন্যপ্রাণীকে বান্দরবান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও লাঠিটিলার বন থেকে এনে প্রদর্শনীকেন্দ্রে ঝুলিয়ে রাখেন। এরা দলছুট হাতি উদ্ধারে জানপ্রাণ দিয়ে দেন, দেশি মিডিয়া থেকে বিবিসি পর্যন্ত এদের কাভার করে। অথচ দেশের সকল হাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এই লম্ফঝম্প চোখে পড়ে না।

কিছুদিন আগে এক আলোচনায় আমি বলেছিলাম- ”বাংলাদেশের যে কয়টা কালো ভাল্লুক আছে তার সিংহভাগ আছে হয় সাফারি পার্কে নয় চিড়িয়াখানায়।” একজন বন্যপ্রাণীর কর্তা বললেন- ”ওখানে আছে বলেই টিকে আছে, নইলে প্রকৃতিতে তার টিকে থাকার পরিবেশ নেই।” প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য আবাসস্থল সংরক্ষণে গুরুত্ব না দিয়ে বন্দি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেমন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এটা আমার মাথায় আসে না!

পৃথিবীর অনেক দেশে যেখানে বন্যপ্রাণী মানুষের দেয়া খাবার খেলে তাকে ইকোসিস্টেম থেকে অপসারণ (remove) করা হয়, আমাদের দেশে উল্টো! বন থেকে এনে মানুষের দেয়া খাবার খাইয়ে বন্যপ্রাণীকে কোন কোন ক্ষেত্রে বনে ফেরত দেয়া হয়। কেশবপুরের হনুমান চড়মুগুরিয়ায় বানরকে মানুষের মতো কলা রুটি খেতে দেয়া হয়। এরকম করলে তা আর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা থাকে কিনা এটা একটা প্রশ্ন।

এরকম হয় বলেই সাধারণ মানুষ বন্যপ্রাণের দায়িত্ব নিতে চায় না। হাতি লইয়া মিনিট কয়েক তামাশা দেখিয়া তারপর ভুলিয়া যায়। ইকোসিস্টেমে বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব না বুঝে নিজ নিজ এলাকার সাপ, হনুমান, খাটাশ, গন্ধগকুল ও মেছো বিড়াল ধরে কিংবা মেরে বন্যপ্রাণী দপ্তরের খোঁজ করে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বনের যারা দখলদার তারা তো বলেই বসেন বনবিভাগ যেন তাদের এলাকা থেকে হাতি সরিয়ে নেন। প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামো স্থাপনের জন্যেও হাতির আবাসস্থল ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এখানেও নীরবতাই সকলে শ্রেয় বিবেচনা করেন।

তাই “হাতি লইয়া আমরা কী করিবো?” আমার এই প্রশ্নের আলোচনা না করে (১) বিব্রত হওয়া যেতে পারে, হাতি মরুক। (২) সব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে আরো ভেবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। (৩) বন্যপ্রাণীকে খাঁচায় পুরিয়া প্রদর্শনীর (তামাশা দেখার) ব্যবস্থা করা যাইতে পারে, এটিই যখন এক শ্রেণির বিষেশজ্ঞের মতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের একমাত্র উপায়!

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, আরণ্যক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।