
বাংলাদেশের উপকূলে নতুন প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে এটি শনাক্ত করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ভেনম রিসার্স সেন্টারের গবেষকরা। ২৬ জুলাই, সোমবার এ নিয়ে চেকলিস্ট নামক আন্তর্জাতিক সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্র। নতুন এই সামুদ্রিক সাপের ইংরেজি নাম- পার্সিয়ান গালর্ফ সী স্নেক/Persian Gulf Sea Snake। বৈজ্ঞানিক নাম- হাইড্রোফিস ল্যাপমোইডস/Hydrophis Lapemoides।
গবেষকরা জানান, শনাক্ত হওয়া সাপটি এলাপিডে/Elapidae পরিবারভুক্ত একটি তীব্র বিষধর সামুদ্রিক সাপ। আর আগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে মালাক্কা প্রণালী পর্যন্ত দেখা গেছে এই সাপটি। মূলত ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের উপকূলীয় ও উপকূল নিকটবর্তী সমুদ্র অঞ্চলে সাপটির বিচরণ বেশি।
এতদিন বাংলাদেশের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের সৈকতেও সাপটি বিচরণের তথ্য ছিল। তবে এই প্রথম বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে শনাক্ত হলো ’পার্সিয়ান গালফ সী স্নেক’। প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএনের গবেষক রাসমুসেন ২০১০ সালে সর্বপ্রথম ধারণা করেছিলেন, এই সাপটি থাকতে পারে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলেও। তবে কখনো সাপটি বাংলাদেশের উপকূলে দেখা যাওয়ার নজির নেই বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।
বাংলাদেশে সামুদ্রিক সাপের নতুন প্রজাতিটি শনাক্ত করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেলের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের সহকারি গবেষক ইব্রাহীম আল হায়দার এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
সাপ গবেষক ইব্রাহীম আল হায়দার বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”সামুদ্রিক সাপের প্রজাতি নিরূপণ করা অত্যন্ত কঠিন। স্থলভাগে বিচরণ করা সাপের মতে শুধু দেখে বা ছবি প্রত্যক্ষ করে সামুদ্রিক সাপের প্রজাতি শনাক্ত করা যায় না। এমনও হতে পারে, এই প্রজাতির সাপ আগেও বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে ছিল। কিন্তু যথাযথ গবেষণার অভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ভাগ্যক্রমে সাপটি আমরা পেয়েছি।”
”চলতি বছরের ২রা জানুয়ারির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অবস্থিত একটি বাজারে বিক্রেতার ঝুঁড়িতে মাছের সঙ্গে সাপটি পাওয়া গিয়েছিল। পরে আমরা উদ্ধার করে ভেনম রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে আসি। মাছ বিক্রেতা জানিয়েছিলেন, চট্টগ্রামের ফইল্যাতলী বাজার থেকে মাছগুলো কিনে বিক্রি করতে এনেছিলেন। মাছের সঙ্গে সাপটিও চলে আসে, যা কেউ খেয়াল করেনি,” যোগ করেন ইব্রাহীম আল হায়দার।
গবেষণায় জানা যায়, জেলেরা আগের রাতে চট্টগ্রামের ফইল্যাতলী সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরেন। সে সময় জালে সাপটি ধরা পড়ে, যা তারা বুঝতে পারেনি। পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাপটির তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন ভেনম রিসার্স সেন্টারের গবেষকরা। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সাপটির প্রজাতি সম্পর্কে নিশ্চিত হন। সাপটির বাংলা কোন নাম নেই। যেহেতু এই প্রজাতির সাপ পারস্য উপসাগরে বিচরণ করে, তাই ‘ইরানী সামুদ্রিক সাপ’ নামেই এটিকে অভিহিত করেছেন গবেষকরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক দলের প্রধান আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”বাংলাদেশে এই সাপের ভাগ্যও হয় অন্যান্য সামুদ্রিক সাপের মতো, মাছ ধরার জালে মারা যায়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলের অধিবাসীরা সামুদ্রিক সাপ খেয়ে থাকে। পাশাপাশি উপকূলীয় বনাঞ্চল ও কোরাল ধ্বংসের কারণে এই প্রজাতির সামুদ্রিক সাপের বাস্তুসংস্থান বিলীন হচ্ছে। তাই সামুদ্রিক পরিবেশ টিকিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এই সাপ সংরক্ষণে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।”
আইইউসিএনের তালিকায় বাংলাদেশে মোট ১৬ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ নথিভুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে নয় প্রজাতির সাপ নুন্যতম বিপদগ্রস্ত, তিন প্রজাতির পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। আর চার প্রজাতির সাপ তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশে এদের উপস্থিতির নিশ্চিত কোন তথ্য নেই।
বাংলাদেশে ম্যাক্লেলান্ডের প্রবাল সাপ, ডাউডিনের সামুদ্রিক সাপ, বড়শিনাক সামুদ্রিক সাপ, কাল-হলুদ বলয়ে সামুদ্রিক সাপ, ডোরা সামুদ্রিক সাপ, মোহনা সামুদ্রিক সাপ, বইঠা টেবি সাপ, হলুদমুখো সামুদ্রিক কেউটে, কালোবলয়ী সামুদ্রিক কেউটে, ক্যান্টরের সরুমাথা সামুদ্রিক সাপ, ছোটমাথা সামুদ্রিক সাপ, মালাক্কা সামুদ্রিক সাপের বিচরণ রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ দেখা মিলে সুন্দরবনের নদীমোহনা, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপ, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চেলের সমুদ্র উপকূলে।