করোনাকালে কেমন ছিল শহুরে পাখিরা?

২০২০ সালের মার্চের শেষে করোনা মহামারীর কারণে পুরোপুরি লকডাউনে চলে যায় বাংলাদেশ। বিশেষ করে যান্ত্রিক জীবন একেবারে অচল হয়ে পড়ে। সেই থেকে এখনও বাংলাদেশজুড়ে বলবৎ আছে লকডাউন। তবে গেল বছর মানুষ যখন ঘরবন্দি ছিল তখন কেমন ছিল শহরের বুনো পশুপাখিরা? শহরের স্থবির পরিবেশে তাদের বিচরণই বা কেমন? এ নিয়ে করা আমার একটি গবেষণা নিয়ে এই লেখা।

গেল বছর পুরো লকডাউনজুড়ে ছিলাম জামালপুর শহরে। আমার মাস্টার্সের থিসিসের কাজ শুরু হয় মারজাত বাওর, ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জে। কিন্তু করোনা লকডাউনের কারণে থমকে যায় কাজ। এ সময় আমার সুপারভাইজার পরামর্শ দেন করোনা মহামারীর লকডাউনে জামালপুর শহরের পাখিদের অবস্থা নিয়ে কিছু করতে পারি কিনা, তবে সেটা অবশ্যই পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে এবং নিয়ম কানুন মেনে।

করোনা লকডাউন যে শহুরে প্রাণীদের জন্য কতটা আশীর্বাদ ছিলো তা তাদের সাড়াতেই বোঝা গিয়েছিল। শহরে, আমাদের বাসার ঠিক পাশেই প্রায় শিয়াল, খাটাশ বনবিড়াল দেখা যেত। শহরের যে কর্ম ব্যস্ত রাস্তাঘাট, সন্ধ্যায় সেখানে পেঁচা দের ছোটাছুটি, রাস্তার উপর ডাহুক তার বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরছে। এছাড়া মুনিয়াদের ছোটাছুটি, রাঙা চ্যাগার ঘুরে বেড়ানো।

গ্রীষ্মে বউ কথাকও, চাতক পাখি ও করুণ পাপিয়াদের সুর লহরী। ছাতি ঘুরাণীদের নাচানাচি আর সাহেব বুলবুলির মা বাচ্চাদের ছোটাছুটি। রাস্তার পাশের কাঠ ঠোকরারা নিশ্চিন্তে নিচের দিকে নেমে আসতো। আর শহরের জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির বগা বগলাদের স্বত:স্ফূর্ত জীবন দেখে আসলে অন্য রকম লাগতো। সত্যি বলতে শহুরে পরিবেশে লকডাউন চলাকালীন সময় পাখিদের এমন ছোটাছুটি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যেত।

শহরে আমরা এই পাখিদের আবাস ধ্বংস করে, এদের যে কোনঠাসা করে রেখেছিলাম এদের ছোটাছুটির আনন্দে হয়তো এই জিনিসগুলোই প্রকাশ পেয়েছে। প্রফেসর ড. ফিরোজ জামান, মো. মাহাবুব আলম ও মো. ফজলে রাব্বীর তত্ত্বাবধানে করা আমার গবেষণায় ওই বছর মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট আট মাসে ১৩৪ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। যা এ দেশের মোট পাখির ১৯.৫৬ শতাংশ। আর গণনাকৃত পাখির সংখ্যা ছিলো চার হাজার ৩৩৮টি। এই পাখিদের মধ্যে ১১৫টি প্রজাতি বাংলাদেশের আবাসিক পাখি এবং ১৯ প্রজাতি পরিযায়ী।

জুন মাসে পাখিদের বৈচিত্র্য সব থেকে বেশি ছিলো। আর বেশি প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছিল মার্চে। গ্রীষ্মে ও বর্ষা ঋতুর মধ্যে বেশি সংখ্যক পাখির দেখা মেলে গ্রীষ্মে। পাখিদের মধ্যে সব থেকে বেশি বুলবুলি (রেড ভেনটেড বুলবুল) ৬ দশমিক ১১ শতাংশ দেখা যায়। সম্প্রতি করোনাকালীন লকডাউন পরিস্থিতিতে জামালপুরের শহরের পাখি নিয়ে গবেষণা পত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার ফলাফল এটাই নির্দেশ করছে যে শহরে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট করে কতটা কোনঠাসা করে রেখেছে মানুষ। অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে বিনষ্ট হচ্ছে পাখি ও তাদের আবাসস্থল। নগর বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণে দরকার যথাযথ উদ্যোগ। যেকোন উন্নয়ন কাজের সময় পাখির বাসস্থানের নিরাপদ রাখার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। পাখি শুন্য হলে প্রাকৃতিক ভারসম্য হারাবে। আর শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হবে মানুষই, যা প্রমাণ করছে করোনা মহামারী।

লেখক: বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ও গবেষণা সহকারী।