লজ্জাবতী বানর নিয়ে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার তালবাহানা!

বনের লজ্জাবতী বানর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উদ্ধার হওয়া বনের লজ্জাবতী বানরগুলো এখনো বনবিভাগে হস্তান্তর করেনি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ উঠেছে। বনবিভাগের দাবি, বারবার তাগাদা দেয়ার পরও বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করে খাঁচায় রাখা তিনটি লজ্জাবতী বানর হস্তান্তর করছে না চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। আর লজ্জাবতী বানর সংবেদনশীল প্রাণী হওয়াতে শিগগিরই প্রকৃতিতে অবমুক্ত না করলে বানরগুলো মারা যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বন কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, গেল ৭ জুন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাগান বাজার ইউনিয়নের রাবার বাগান এলাকায় লজ্জাবতী বানর আটক করে স্থানীয়রা। পরে সেটিকে খাঁচায় আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার লোকজন গিয়ে বানরটি নিয়ে যায়। এর আগেও আরো দুটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে নেয়া হয় চিড়িয়াখানাটিতে। এনিয়ে গত ১০ জুন বেঙ্গল ডিসকাভারে সংবাদ প্রকাশিত হলে বানরগুলোকে দ্রুত বনে ‍অবমুক্ত করতে আহ্বান জানান প্রাণীবিদ ও সংরক্ষণকর্মীরা। পরবর্তীতে চিড়িয়াখানাটিতে থাকা তিনটি লজ্জাবতী বানর প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে উদ্যোগ নেয় বনবিভাগও।

চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আবু নাছের মো. ইয়াসিন নেওয়াজ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”আমাদের রেঞ্জ কর্মকর্তারা কয়েকবার চিড়িয়াখানা গিয়েছেন। কিন্তু ওখানে কর্তাব্যক্তিরা ওই তিনটি লজ্জাবতী বানর দেয়নি। বিলুপ্ত লজ্জাবতী বানর তিনটিকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা খাঁচা মধ্যেই রেখেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এটা তারা করতে পারে না, কারণ বানরগুলো খাঁচায় বেশিদিন রাখলে মারা যেতে পারে।”

তিনি বলেন, ”বানরগুলো বিষয়ে চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক ও হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমিন ও ফটিকছড়ি ইউএনও মো. সায়েদুল আরেফিন সাথে বন কর্মকর্তাদের আলাপ হয়েছে। তারা বলেছেন লজ্জাবতী বানরগুলো চিড়িয়াখানা থেকে নিয়ে যেতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তবু অজানা কারণে বানরগুলো অনেকদিন পড়ে আছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাতে।”

বিভাগীয় বনকর্মকর্তা আবু নাছের মো. ইয়াসিন নেওয়াজ বলেন, ”চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কিউরেটর শাহাদাত হোসেন কেন বানরগুলো রেখে দিতে চায় তা আমি জানি না। এগুলো চিড়িয়াখানায় থাকে না, এরা গভীর বনে থাকে। প্রাণীগুলোকে রেখে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ কি লাভ আমি জানি না বা কি করতে চাচ্ছে আমার জানা নেই। আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি এগুলো নিয়ে বনে ছেড়ে দিতে। কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টির কর্ণপাতই করছে না। আর কিছুদিন লজ্জাবতী বানরগুলো ওখানে থাকে, তাহলে মারা যাবে। এ বিষয়ে আমরা (বনবিভাগ) ডিসি বরাবর চিঠি লিখবো।”

অপরদিকে কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “আমাকে চিড়িয়াখানার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। তাই আমি বানরগুলো দিতে পারিনি। আর লজ্জবতী বানরগুলো এখানে সুস্থ আছে। যদি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয় আমার দিতে কোন সমস্যা নেই।”

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক ও হাটহাজারী ইউএনও রুহুল আমিন বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, ”আমার সাথে বনবিভাগের কথা হয়েছে। কিন্তু আমাকে ফটিকছড়ির ইউএনও মো. সায়েদুল আরেফিন যদি বলে আমাদের দিতে সমস্যা নেই। আর একটি বিষয় হলো আমাদের ওখানে আরো দুটি লজ্জবতী বানর আছে, সেগুলোর কোন সমস্যা হয়নি। আশা করি নতুন আনা বানরটিরও কোন সমস্যা হবে না। আমরা বিলুপ্তপ্রায় লজ্জাবতী বানরের বংশবৃদ্ধি করানোর চেষ্টা করছি।”

এর আগে ১০ জুন লজ্জাবতী বানর বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর না করা প্রসঙ্গে কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেছিলেন, ”যখন বনের কোন প্রাণী লোকালয়ে ঢুকে পড়লে স্থানীয়রা ধরে বনবিভাগকে জানায়। কিন্তু প্রায়ই বনবিভাগ এসব বিষয়ে রেসপন্স করে না বা উদ্ধারের উদ্যোগ নেয় না। পরে স্থানীয়রা আমাদের জানালে আমরা প্রাণীটির জীবন রক্ষার্থে বা চিকিৎসার প্রয়োজনে চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসি।”

প্রাণীবিদদের মতে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল বন্যপ্রাণীর হটস্পট। বিলুপ্ত প্রায় বহু প্রাণী এখনো টিকে রয়েছে এ জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চল এলাকায়। তবে অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বনাঞ্চলে বিচরণ করা বন্যপ্রাণীগুলো আটক হলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা সেগুলো এনে খাঁচাবন্দী করা হয়। যা বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের পরিপন্থী।

বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদ আসিফ বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, যেকোন বন্যপ্রাণী উদ্ধার বা সংরক্ষণের নিয়ম আছে। যেকোন মানুষ, চিড়িয়াখানা বা সংস্থা কোথাও থেকে কোন বন্যপ্রাণী উদ্ধার করলে সঙ্গে সঙ্গে তা বনবিভাগকে অবগত করতে হবে। বনভিবাগের সহযোগিতা না পেলেও প্রাণীটিকে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে হবে। তবে কোনভাবেই খাঁচায় ভরে রাখা যাবে না। আর চিড়িয়াখানারও এখতিয়ার নেই এভাবে বিরল প্রজাতির বানর রাখার।

”লজ্জবতী বানর বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বানর। ঢাকার মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায়ও একটি লজ্জাবতী বানরও নেই সেখানে দুর্লভ ও বিরল প্রজাতির এই বানর চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়ও রাখার ‍সুযোগ নেই,“ উল্লেখ করেন গবেষক আদনান। বলেন, ”আমি নিজেও গিয়ে দেখেছি, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার খাঁচায় আরো লজ্জবতী বানর রয়েছে। যেগুলো দেয়া খাবারও সঠিক ছিল না। শুধু কলা খেতে দেয়া হয় বানরগুলোকে, যা বানরটির ফুড হেবিটের সঙ্গে মিল নেই।”

”লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী সম্পূর্ণ। এরা সূর্য আলো লাগলে বানরটির চোখে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরা দিনে গাছ লুকিয়ে থাকে এবং হাত ও পা দিয়ে চাপ দিয়ে মুখ ঢেকে বলের মতো গোল হয়ে থাকে, যাতে আলো না লাগে। এরা মূল খাবার বিভিন্ন গাছের আঠা, মথ, কচিপাতা ও পোকা।”

লজ্জাবতী বানরের ইংরেজি নাম বেঙ্গল স্লো লরিস। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও লাউস পর্যন্ত এদের বিচরণ। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে বানরটিকে দেখা যায়। প্রকৃতি ও প্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএন লজ্জাবতী বানরকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনের তফসিল-১ অনুসারে সংরক্ষিত প্রাণী লজ্জাবতী বানর।