
করোনার কারনে গৃহবন্দি থাকতে থাকতে বাচ্চারা ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে তাই ভাবলাম ওদের নিয়ে নির্জন কোথাও ঘুরে আসি। জুনের এক ভোরে গেলাম ঢাকার তিনশো ফিট এলাকার দিকে। ঘুরতে ঘুরতে একটা নদী পেয়ে গেলাম সেটা লক্ষ্য করে গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। তারপর বেশ কয়েকমাইল গিয়ে একটা খুবই নির্জন একটা গ্রামও পেয়ে গেলাম, যেখানে মাত্র দু-তিনটা বাড়ি। বাড়ির চারিদিকে যেদিকে চোখ যায় সবজি আর সবজি।
সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করে ফেরার সময় একজন কৃষকের বাড়িতে ঢুকলাম কিছু টাটকা সবজি কেনার জন্য। বাড়ির সামনেই তাঁর সবজি মাচার একটি কাঁকরোল গাছের দিকে চোখ আটকে গেল। কারণ এটা সাধারণ কাঁকরোল নয়। এর রঙটি দুর্লভ বন কাঁকরোলের মত কিন্তু অতবড় নয় মাঝারি। বিস্ময়ে কাছে গিয়ে দেখি এটা হারিয়ে যাওয়া আমাদের দেশি কাঁকরোল।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিনি বহু যত্ন করে এই হারিয়ে যাওয়া জাতটিকে সংরক্ষণ করে চলেছেন নিজে খাবার জন্য, বিক্রি করেন না। আমাদের দেশে বাজারে যে কাঁকরোল দেখা যায় সেটা আমাদের দেশি জাত নয়। পরিবেশের বিরূপ প্রভাব এবং সংরক্ষণের অভাবে এই দেশি জাতটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এ দেশি জাতটির ফলনও কম হয়, তাই চাষীরা দেশি ছেড়ে বিদেশি জাতের কাঁকরোল চাষ শুরু করে। আর এভাবেই আমদের দেশি জাতটি একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
বিদেশি জাতটির ফলন বেশি হলেও খেতে দেশি জাতটির মত এত স্বুস্বাদুও নয় এবং শক্ত বিচি থাকে। কিন্তু দেশি জাতটি খেতে যেমন স্বুস্বাদু তেমনি এর বিচি খুবই নরম, এত নরম যে কাটারেই কাটা যায়। এই দেশি জাতটির গায়ের রঙ গাড় সবুজ আর কাঁটাগুলো কিছুটা মসৃন। এর পাতার আগাগুলো কাঁটাযুক্ত। ফুলেও সাইজে এবং দেখতেও সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
সেদিন বেশ কিছু সবজি কৃষক ভাইটির ক্ষেত থেকে নিলাম এবং বিনিময়ে মূল্যও দিলাম। এরপর লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েই তার কাছ থেকে দুটি কাঁকরোল চেয়ে বসলাম। বাসায় এসে রান্না করে খেয়ে দেখলাম দেশি কাঁকরোলের স্বাদ অপূর্ব। শ্রদ্ধা সেই কৃষক ভাইকে যিনি এই দুর্লভ জাতটিকে সংরক্ষণ করে চলেছেন।
বাংলা নাম কাঁকরোল বা কাকরোল বা গোলকাক। ইংরেজিতে বলা হয় Sweet Gourd, Giant spine Gourd, Spiny Bitter Cucumber। বৈজ্ঞানিক নাম Momordica cochinchinensis।
কাঁকরোল একটি জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন সবজি। বাংলাদেশে কুমড়া পরিবারের যত সবজি আছে এরমধ্যে কাঁকরোল সবচেয়ে দামি এবং চাহিদাসম্পন্ন সবজি। কাঁকরোল চাষের জন্য দোআঁশ মাটি বা বেলে-দোআঁশ মাটি প্রয়োজন। সাধারণত মধ্য এপ্রিল থেকে জুন মাসে এর বীজ বা মোথা/কন্দ রোপণ করতে হয়। তবে বীজ থেকে কন্দমুলে ভাল গাছ জন্মায়। একই গাছে পুরুষ এবং স্ত্রী ফুল হয় না। এজন্য পরাগ মিলনের জন্য বাগানে দুই ধরনের গাছই থাকতে হবে, নাহলে ফল হয় না। বাংলাদেশের সব জায়গাতেই এর চাষ হয়।
কাঁকরোলর বিস্তৃতি ভারত, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও অস্ট্রেলিয়া। কাঁকরোল একটি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ সবজি। এটি উদ্দীপক, পাকস্থলীর জন্য খুবই উপকারি এবং কাশি উপশমকারী। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণ কালশিয়াম, ফসফরাস এবং ক্যারোটিন আছে। এটা ভিটামিন বি এবং সি’র ভালো উৎস।
গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের স্নায়বিক দুর্বলতা দূর করতে বেশ কার্যকর। ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো, ত্বককে তারুণ্যদীপ্ত করা এবং বয়সের ছাপ কমাতে সাহায্য করে কাঁকরোল। এর পাতা বাতের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ফোঁড়া মিলানোর জন্যও ব্যবহার করা হয় কাঁকরোলের বীজ।
লেখক: প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ক আলোকচিত্রী, বাংলাদেশ।