(পর্ব-০৩) ফুন্টশিলিং থেকে থিম্পু আসার পথে যেমন বৃষ্টি পেয়েছিলাম তেমনটা থিম্পু থেকে পুনাখা যাবার পথে পাইনি। বৃষ্টি না হলেও আকাশ একটু মেঘলা ছিল। এই পথও একই রকম সুন্দর। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা। পথে কিছু ছোট বসতি, ফল সবজির দোকান পেয়েছি। যাত্রাপথে ডোচুলা পাস পেরোতে হয়। উচ্চতা প্রায় ৩১০০ মিটার। এখানে ১০৮টি চোর্তেন বা স্তূপ আছে।
মেঘ কুয়াশায় ঢাকা না থাকলে এখান থেকে হিমালয়ের শৃঙ্গগুলো দেখা যায়। আমরা ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম কুলাকাংড়ি ভূটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। এখন মনে হয় চোমোলহরী পড়ানো হয়। কিন্তু এখানে জানলাম ৭ হাজার ৫৭০ মিটার উচ্চতার গাংখর ফুনসুম (Gangkhar Puensum) ভুটানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। কখনো সুযোগ পেলে ছাত্রছাত্রীদের ঠিকটাই শেখাবো। এতে পরীক্ষার খাতায় দু’এক নম্বর কম পেলেও ক্ষতি নেই। আসলে স্কোরবোর্ডের মতন মার্কশিটও যে গাধা।
গাংখর ফুনসুম শৃঙ্গে এখনো কেউ আরোহণ করেননি। কোনোদিন করতেও পারবেন না। কারণ এই শৃঙ্গে উঠতে পর্বতারোহীদের অনুমতি দেয়া হয় না। শৃঙ্গের বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা ও জীববৈচিত্র রক্ষা করতে এবং অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে এমন সিদ্ধান্ত ভুটান সরকারের।
এভারেস্টসহ হিমালয়ের অন্য শৃঙ্গগুলোর পরিবেশ যখন মাত্রতিরিক্ত পর্বতারোহীদের সামিট করার চাপে হাঁস-ফাঁস করছে, সেখানে ভূটানের মত ছোট দেশের এমন সিদ্ধান্ত ব্যতিক্রমী। তাই পর্বতারোহীদের থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিবর্তে দেশের পরিবেশ আর মানুষের কথা আগে ভাবার জন্য ভূটানকে কুর্নিশ।
পুনাখার প্রধান আকর্ষণ পুনাখা জং, মানে ‘জং’ হল জেলা হেডকোয়ার্টার। অনেকেটা দুর্গের মতন। একসঙ্গে যেখানে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাজ হয়, আর সাথে থাকে বুড্ডিস্ট স্কুল। মনাস্ট্রি আর জং এর এটাই মূল পার্থক্য। ১৯৫৫ পর্যন্ত পুনাখাই ভূটানের রাজধানী ছিল, পরে তা থিম্পুতে স্থানান্তরিত হয়। ভুটানের প্রাচীন জং-গুলো ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত।
পুনাখা ছাড়াও লিস্টে আছে ওয়াংডু, পারো, টোংসা ও ডাগানা। পথে যেতে ডেচেন দেখালো, দুই নদী মিলে সৃষ্টি হয়েছে পুনাসাঙ্গ ছু (Punatshang chhu)। পরে ম্যাপে দেখেছি নদীগুলোকে মো ছু (Mo chhu) আর ফো ছু (Pho chhu) বলে উল্লেখ করা আছে। এই নদীর পাশেই পুনাখা জং অবস্থিত।
পুনাসাঙ্গ ছু যে দুটি নদীর মিলিত প্রবাহ এর একটিকে মেল বিভার (পুরুষ নদী) আর অন্যটাকে ফিমেল রিভার (নারী নদী) বললো ডেচেন। সেই আমাদের নদ-নদীর ধারণার মতন। যার কোনো সুস্পষ্ট যুক্তি বা বাস্তব ভিত্তি নেই। প্রশ্ন করতে ডেচেন বললো, জলের রং গাঢ় হলে তা পুরুষ নদী… বোঝো কাণ্ড!
পুনাখা জং-এর টিকিট ৩০০ টাকা করে। আর টিকিট কাউন্টারের বাইরে নোটিশ বোর্ডে উল্লেখ আছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশানুসারে নতুন ভারতীয় ২০০০, ৫০০, ২০০, ১০০ ও ৫০ টাকার নোট গ্রহণ করা হবে না। শুধু পুরনো ১০০ আর ৫০ টাকা নেয়া হবে। এ তো চরম মুশকিল আমরা মোট ১৩ জন। কুড়িয়ে বাড়িয়েও এত পুরনো ১০০ এর নোট হবে না।
তবে উড়ে মালি পাশেই ছিলেন। তিনিই মুশকিল আসান করলেন। বেঁটে খাটো ভূটানি, ট্র্যাডিশনাল ড্রেস ঘো পরা। হাতে এক তাড়া ভারতীয় নোট নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। উনিই নতুন ৫০০ এর নোট পাল্টে পুরনো ১০০ এর নোট দিয়ে দিলেন। তবে এজন্য তিনি কমিশন নেননি। জং-এর সিকিউরিটির জন্যে যে পুলিশ ছিলেন তিনি বললেন, ভারতীয় টুরিস্টদের সাহায্য করাই ওনার কাজ। নীল জ্যাকারান্ডা ফুলে সেজে ওঠা পুনাখা জং দেখার থেকে এমন মানুষদের সাথে আলাপ হওয়াও কম সৌভাগ্যের নয়।
লেখক:গবেষক ও শিক্ষক, ভারত
চলবে… (পর্ব-০৪, আগামীকাল)