দেশটিতে রাস্তার কুকুর নির্ভয়ে দোকানে ঢুকে…

ভূটানের থিম্পুতে একটি পথ কুকুর। ছবি: শুভদীপ অধিকারী, ভারত

(পর্ব- ০২) থিম্পুতে পৌঁছে প্রথমেই যে কাজটা করতে হয় তা হলো ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে পুনাখার জন্যে অনুমতি নেয়া। যদিও ভোরে আমি আর সহযাত্রী কণাদ দা উদ্দেশ্যহীনভাবে হোটেলের আশপাশে একটু হাঁটাহাঁটি করে এসেছি। তবে হোটেলটা মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে হওয়াতে শহরটি আর ঘুরে দেখা সম্ভব হয়নি।

হোটেল থেকে দুশো টাকা ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে যাই ইমিগ্রেশন অফিস, সহযাত্রী জ্যোতি কাকু আর চেনচো’র সাথে। চেনচো আমাদের ড্রাইভার, আমাদের ভূটান ভ্রমণের সঙ্গী। দেশটিতে অফিস শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায়। এদেশে কলকাতার মতন হলুদ বা কালো ট্যাক্সি নেই। গাড়ির নম্বরে বি.টি থাকা মানেই হলো ভুটান ট্যাক্সি। বি.পি হলে প্রাইভেট গাড়ি আর বি.জি হলে ভুটান গভর্নমেন্ট। এছাড়া রাজ পরিবার, রয়াল ভুটান আর্মি, রয়াল ভুটান পুলিশের গাড়িতে ভুটান, আর.বি.এ আর আর.বি.পি লেখা থাকে।

গাড়িতে উঠতেই সেটি শহরের দিকে না গিয়ে উল্টোদিকে চলতে শুরু করে। ইউটার্ন নিয়ে অন্য প্রান্ত যেতে হবে। কিন্তু প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে তবে গাড়ি শহর অভিমুখে টার্ন নিল! কলকাতার দক্ষ ও নির্ভীক চালক হলে এর অনেক আগেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিত। এই রাস্তায়ও এমন সুযোগ ছিল, কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ।

বুদ্ধা ডোরডেনমা, থিম্পু।ছবি: শুভদীপ অধিকারী

ইমিগ্রেশন অফিসের সার্ভিস কাউন্টার বড় রাস্তার ধারেই ফুটপাথে। ছোটোখাটো একটা অফিস, বাইরে বোর্ড না থাকলে আলাদাভাবে চেনাই মুশকিল। ভিতরটা আমাদের যেকোনো হেড পোস্ট অফিসের থেকেও ছোট। কোনো আড়ম্বর নেই। ইমিগ্রেশন অফিসেই আমাদের সঙ্গে যোগ দেন আমাদের গাইড ডেচেন। আশ্চর্য টেলিপ্যাথি। থিম্পুতে আমাদের হোটেলের নামও তাই! চেনচো আর ডেচেন, দুজনের বাড়িই পারো। অফিসে যে পর্যটক দেখলাম, সকলেই ভারতীয়। ভুটানে যারা আসেন এর অধিকাংশই ভারতীয়। আমাদের দেশের সাথে সম্পর্কও খুব বন্ধুত্বপূর্ণ।

ভারতীয়দের ভুটান যেতে পাসপোর্টও লাগে না। ভোটার কার্ড আর এক কপি ছবি থাকলেই চলে। যদিও ফুন্টশিলিং বা থিম্পু দুই জায়গার ইমিগ্রেশন অফিসেই দেখলাম, অধিকাংশ ভারতীয় পর্যটকই পাসপোর্ট এনেছেন! কে জানে এত মানুষের হয়ত ভোটার কার্ড নেই! নির্বাচন কমিশনের উচিত উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া।

ভুটানের বর্তমান রাজা ও রানী

ভুটানের সব জায়গায় রাজা জিগমে খেসার নামগিয়াল ওয়াংচুকের ছবি। কোথাও একা বা কোথাও পরিবারসহ। রাজার উত্তরসূরিদের ছবিও আছে। আমাদের দেশে রাজা না থাকলেও এমন ছবি দেখতে আমরাও অভ্যস্ত। কিন্তু এদেশের মানুষ রাজাকে ভগবানের মতন শ্রদ্ধা করেন। তাই তাঁদের উপস্থিতি সর্বত্র। বর্তমান রাজা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও সাধারণ মানুষের কাছে রাজাই শেষ কথা। রাজার রাজত্বে সবাই রাজা না হলেও সবাই খুশি। তাই ভুটানের উন্নয়নের সূচক গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। ইমিগ্রেশন অফিসের কাছেই জি.এন.এইচ-এর অফিস দেখলাম।

এখানে দেখলাম রাস্তার কুকুরদের নির্ভয়ে দোকানে ঢুকে যেতে বা দোকানের সামনে বসে থাকতে। কিন্তু কেউ তাদের বিরক্ত করে না বা লাঠি নিয়েও মারতে যায় না। এটা পশুপ্রেম না সহনশীলতা জানি না। তবে মানবিক মূল্যবোধের দিক থেকে নাক চ্যাপ্টা ভূটানিরা আমাদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে তা বুঝেছি। মার্কেটিং শেষে পৌঁছাই ক্লক টাওয়ারে।

বলা বাহুল্য সেখানেও কোনো চাকচিক্য দেখলাম না। শহর পরিক্রমায় বেরিয়ে দূর থেকে ভূটানের রাজার বাড়ি দেখেছি। বৈভবের দিক থেকে সেটাও আহামরি কিছু নয়। আমাদের রাইসিনা হিলস বা রাজভবন এর থেকে বেশি সমৃদ্ধ। রাজার পরিবারের প্রতি এত শ্রদ্ধার কারণ জানতে চাওয়ায় উল্টে চেনচো আমাদের প্রশ্ন করে- তোমাদের দেশে যুদ্ধ হলে তোমাদের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধে যান? আমি ইতিহাসের ছাত্র নই তবুও সম্মুখ সমরে কোন প্রধানমন্ত্রী যাননি বলেই জানি। চেনচো বলে ২০০৩ সালে আগের রাজা জিগমে সিংগী ওয়াংচুক নিজে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। পরে গুগল করে দেখি ব্যাপারটা সত্যি। দেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাকামী গেরিলা শক্তিকে প্রতিহত করার জন্যে রাজা নিজে রয়াল ভুটান আর্মিকে নেতৃত্ব দেন।

পুনাখা যাবার পারমিশন নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। তারপর যাই শহর ভ্রমণে। থিম্পুতে কি কি দ্রষ্টব্য স্থান আছে তা অনেকেই জানেন, না হলে গুগুল তো জানেই। তাই আমার অত কিছু বলার নেই। তবে ৫১.৫ মিটার উঁচু ওই বিরাট বুদ্ধমূর্তি দেখতে গিয়ে ডেচেনকে প্রশ্ন করি যে মূর্তিটা তৈরির আগে এখানে কি ছিল? বললো জঙ্গল। স্বঘোষিত পরিবেশবিদ হবার জ্বালা আর কি। আবার ওখানকার ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে বিশ্বের বৃহত্তম বই “এ ভিস্যুয়াল ওডিসি অ্যাক্রস দ্যা লাস্ট হিমালয়ান কিংডম” দেখে মনে হল যে বইটার একটা পকেট সাইজ এডিশন করে যদি পর্যটকদের সল্পমূল্যে দেওয়া যেত তাহলে কি ভালোই না হত। না হলে শুধু গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তুলতে ৫০০ কপি এমন ঢাউস বই ছাপিয়ে কি হবে?

বামে ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্টেন ও ডানে ক্লক টাওয়ার, থিম্পু। ছবি: শুভদীপ অধিকারী

থিম্পুতে আমরা ওখানকার জেনারেল পোস্ট অফিসে যাই। এখানে সাধারণ ট্যুরিস্টদের অতটা ভিড় চোখে পড়ল না। এখানে ফিলাটেলিক সামগ্রী ছাড়াও নানান স্যুভেনির পাওয়া যায়। পাঁচশো টাকা দিয়ে পারসোনালাইজড্ স্ট্যাম্পও বানানো যায়। আমাদের দেশের ‘মাই স্ট্যাম্প’ কনসেপ্টের মতন। বিকেলে শহর ঘোরার সুযোগ হয়। উদ্দেশ্য মার্কেটিং-এর। সবাই যে যার মতন জিনিস কেনেন। আমি শুধু দেখে যাই। ভূটান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সামনের চত্বরে সার দেয়া দোকান ঘর। তাতে মুখোশ থেকে শুরু করে উলেনস্ সবই কিনতে পাওয়া যায়। দার্জিলিং ম্যালের পিছনের দোকানগুলোর মতন। কিন্তু এখানে সবটাই চোখ ধাঁধানো- নিট অ্যান্ড ক্লিন। বড় দোকানগুলোও তাই। হাতে গরম প্রাপ্তি যোগ হয় এখানে। সৃজনী কাকিমার দেওয়া টি-শার্ট, অভিজিৎ দা’র চাবির রিং, সুমিতা দি’র ফ্রিজ ম্যাগনেট… আমার প্রাপ্তির ঝুলি এতেই পূর্ণ।

আমাদের চুঁচুঁড়ার ঘড়ির মোড়ের মতন ফ্ল্যাগ বা ফ্লেক্সে মোড়া নয়। বাচ্চাদের শৈশব দিয়ে ঘেরা এখানকার ক্লক টাওয়ার। যার নিচে বাচ্চারা তাইকোন্ডো প্র্যাকটিস করছে বা ফুটবল খেলছে। আমরা সেখানে ছবি তুললে তারাও উৎসাহের সাথে যোগ দিল। এমনকি খেলার জন্যে আমাদের নিয়ে দলও বানিয়ে ফেললো নিমিষেই। কারোর বাবা মাকে ছুটে আসতে দেখলাম না অচেনা মানুষদের সাথে মেলামেশা করার জন্যে। এত কিছু ভালোর মধ্যে একটাই বাজে জিনিস দেখলাম। এখনকার দোকানিরা বার্গেনিং করা একদম পছন্দ করেন না। দামটা একটু চড়া হলেও না। কি আর করা যাবে ওনারা কি আর বাঙালির সেন্টিমেন্ট বোঝেন!

লেখক:গবেষক ও শিক্ষক, ভারত

চলবে… (তৃতীয় পর্ব- আগামীকাল)