
সবুজ পাহাড়টি নিয়ে আছে নানা গল্প। সভ্যতার দীর্ঘ সব ইতিহাসের এক অফুরন্ত ভান্ডার। আধ্যাত্মিক নগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কথা এলে উঠে আসে পাহাটির নাম। বলছি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড়ের কথা।
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণে আনোয়ারা-কর্ণফুলী বিস্তীর্ণ এলাকা জুঁড়ে রয়েছে পাহাটি। এই অঞ্চলেই আরাকানদের চাটিগাঁ দুর্গ ও দেয়াঙ কারাগার ছিল। সেই কারাগারে ১৫শ খ্রিষ্টাব্দে মহাকবি আলাওল আরাকানদের হাতে ধরা পড়ার পর বন্দি ছিলেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পর্তুগিজদের আগমনের পর অঞ্চলটি ফিরিঙ্গি বন্দর নামে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবুজে ঘেরা অগনিত পাহাড় ও টিলা। দেখে মনে হতো যেন ‘সবুজ-গালিচা’।
পাহাড়, সমুদ্র, প্রাকৃতিক লোকের নয়ন জুড়ানো নীল জলরাশি, সবুজে ছেয়ে যাওয়া ভূমি, অসংখ্য পৌরানিক স্মৃতি বিজড়িত তীর্থস্থান, বিখ্যাত মালকা বানু ও মনু মিয়া দীঘি, ছরুতবিবি দিঘী, চাঁন সওদাগরের দিঘী, পারকি সমুদ্র সৈকত, বড়উঠান আন্নর আলী খাঁ জমিদার বাড়িসহ অসংখ্য তিলোত্তমা রূপ দেখতে এই এলাকায় ছুটে আসেন প্রকৃতিপ্রেমীরা।

জানা যায়, চৌদ্দশত খ্রিস্টাব্দে ক্রিশ্চিয়ানো নামে একজন কানাডিয়ান ধর্মযাজক দুর্গম এ পাহাড়ে বসতি স্থাপন করেন। আর এই ধর্মযজাকের রূপক দেয়াঙ নামে একজন খাজনা আদায়কারী ছিল। পরে ধর্মযাজক রূপক দেয়াঙ-কে উৎসর্গ করে এই পাহাড়ের নাম দেন দেয়াঙ পাহাড়। বর্তমানে দেয়াঙ পাহাড়টি আনোয়ারার কোরিয়ান ইপিজেডের অধিনে রয়েছে।
এক সময় পর্তুগিজ খ্রিস্টান পাদ্রি সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারের উদ্দ্যেশে বাংলার আসেন এবং কয়েক বৎসর ১৬২৯-৩৫ সাল চট্টগ্রামের অবস্থান করেন। তাঁর প্রধান কর্মস্থল ছিলো ‘দেয়াঙ’। দস্যুদের বীভংসতায় বিচলিত না হলে ম্যানরিক তাঁর ধর্ম মনোযোগ দেন।
ম্যানরিকের বিবরণে জানা যায়, ধুত বন্দিদের মধ্যে বছরে গড়ে তিন হাজার ৪০০ বন্দি দেয়াঙ-এ আনা হতো। এরমধ্যে দুই হাজার জন খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। জলদস্যুদের দমনে নবাব শায়েস্তা খার নেতৃত্বে আট হাজার সৈন্য পাঠায় তৎকালীন মোগল সম্রাট। মোগলরা আক্রমণ করলে কিছু লুষ্ঠিত মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায় জলদস্যুরা। আর কিছু পর্তুগিজ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যু এ দেশেই থেকে যায়।

পরবর্তীতে মোগল সৈন্যরা সাগর মোহনা থেকে স্থান পরিবর্তন করে প্রায় ২ নটিক্যাল মাইল উত্তরে মগলের পুকুর পাড়ে নুর আহাম্মদ ফকিরের টিলায় অবস্থান করে। সেখান থেকে তারা সোজা পশ্চিমে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর তথা ১৫নং ফেরিঘাট বরাবর এলাকায় অবস্থান নেয়।
তবে সম্প্রতি আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিকল্পিতভাবে কাটছে পাহাড়। এতে পাহাড়গুলো এখন নিশ্চিহ্নের পথে। সেই ধারাবাহিকতায় দেয়াঙ পাহাড়ও আজ বিলুপ্তির পথে। প্রতিনিয়ত কাটা হচ্ছে এই পাহাড়। এতে এই এলাকায় জীব-বৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয়দের বলছেন, প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করলে অবশিষ্ট পাহাড় ও টিলাগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তাই তারা দ্রুত পাহাড় সংরক্ষণের তাগিদ দিচ্ছেন।
দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস গ্রন্থের প্রণেতা জামাল উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসের সাথে ও এটির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এছাড়া দীঘি, পূর্বে চাটিকা দূর্গ ও দেয়াঙ কারাগার ছিলো। একইসঙ্গে মনসামঙ্গল কাব্যের ম্মৃতিও বহন করে এটি। এটি সংরক্ষণ ও রক্ষনাবেক্ষন করা জরুরি। এখনো সময় আছে, সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে পাহাড়টি রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।