বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও পরিযায়ী পাখির অভয়ারণ্যখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টি বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।
তবে এবার প্রাকৃতিক পরিবেশ গুড়িয়ে দিয়ে হল নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এতে গেলো এক সপ্তাহ ধরে ফুঁসে উঠেছে শিক্ষার্থীদের তীব্র বিরোধীতা।
জানা গেছে, হল নির্মাণে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি জায়গা মিলিয়ে কাটা পড়বে মোট এক হাজার ১৩২টি গাছ। এ গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির গাছও। আর জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব তো রয়েছেই।
শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, বিকল্প জায়গা থাকার পরও প্রশাসন অজ্ঞাত কারণে বেছে নিয়েছে প্রাকৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোই। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেছেও তারা। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থী, পরিবেশবিদসহ সর্বস্তরের মানুষ।
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও এতে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অতিথি পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গাছগুলোকে স্ব-অবস্থানে রাখেতে ভিসি বরাবর স্বারকলিপি প্রদান করেছে ‘সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয়টির শাখা কর্তৃপক্ষ। এতে, পতিত জমিতে অবকাঠামো নির্মানের অনুরোধও জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য গত বছরের অক্টোবরে সরকারের একনেক থেকে বরাদ্দ হয় এক হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যা দিয়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পাঁচটি হল নির্মাণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ইতিমধ্যেই ছেলেদের তিনটি হল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলসংলগ্ন এলাকায় এবং মেয়েদের দুটি হল বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের দক্ষিণ দিকে টারজান পয়েন্টে নির্মাণ করা হবে। গত ৩০ জুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম উদ্বোধন করেন হল নির্মাণকাজও।
এরপর থেকেই মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে প্রশাসন। বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে হল নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে শিক্ষার্থীরা। তবে সব সমালোচনার পরও হল নির্মাণে একটুও নড়েনি প্রশাসন, বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও ভূমিরূপ ঠিক রেখেই চলছে নির্মাণকাজ।
শিক্ষার্থীরা বলেন, “আমরা চাই, আবাসন সংকট নিরসনে হল নির্মাণ হোক। কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংস করে নয়। হল করার জন্য কিছু গাছ কাটা লাগতেই পারে, কিন্তু সেটা হতে হবে পরিকল্পিত।” অপরিকল্পিত উন্নয়ন একদিন ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মন্তব্য শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীরা জানায়, যেখানে হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানেই রয়েছে বিলুপ্ত প্রজাতির নানান ফলদ ও বনজ গাছ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের উত্তরে হল নির্মাণে ৬৩টি বিলুপ্তপ্রায় গোলাপজাম গাছ, ১৭টি আমলকীগাছ, ২৩টি কামরাঙা গাছ, ১২টি চালতা গাছসহ বিভিন্ন জাতের প্রায় ৫৩৯টি গাছ কাটা পড়বে। এ ছাড়া হলের পূর্ব পাশে কাটা পড়বে কাঁঠাল, মেহগনিসহ নানা প্রজাতির ৩৫৮টি গাছ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত খেলার মাঠটিতেও নির্মাণ করা হচ্ছে আরেকটি হল। ফলে মাঠের পাশে থাকা ২৮টি গাছ কাটা পড়বে। হলের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য কোনো মাঠও আর থাকবে না। আর ছেলেদের তিনটি হল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তিনদিকে হওয়ায় হলটির আবাসিক শিক্ষার্থীরা নানা সমস্যায় পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
মেয়েদের ১০ তলাবিশিষ্ট হল দুটি নির্মিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টারজান পয়েন্টে। সেখানে একটি পুরনো বটগাছ ও ১৭৮টি কাঁঠালগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ২০৭টি গাছ কাটা হবে বলে আশঙ্কা করছে সচেতন মহল।
হল নির্মাণের স্থান পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ঐক্যমঞ্চ। আর পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে গেলো সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানববন্ধন করেছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও প্রদান করেছে তারা।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করছে, নিয়ম মেনেই এসব গাছ কাটা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেন সংবাদমাধ্যমে বলেন, “আমাদের যে মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে হলগুলো কোথায় হবে, সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নয়ন যদি করতে চাই, তাহলে তো কিছু গাছপালা কাটা যাবেই।”
এই বিতর্ক ও সমালোচনা যখন তুঙ্গে তখনই আজ ১৭ জুলাই ‘বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি-২০১৯’ পালন করছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এদিন নেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল ও কলেজসংলগ্ন পুকুরপারে ৫০০ গাছ লাগানোর কর্মসূচি।