বাংলাদেশের রাজধানীতে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নয়নাভিরাম সবুজ এই ক্যাম্পাস প্রতিদিন কোলাহলে মুখরিত থাকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারিসহ হাজারো মানুষের পদচারণায়। তবে তাদের অগোচরেই এখানো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চারপাশে টিকে আছে ৯৪ প্রজাতির বন্যপ্রাণ। টানা তিন বছরের এক গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে এই প্রজাতিগুলোকে। এতে জানা গেছে কোন কোন প্রজাতি কী অবস্থাতে আছে।
১৯২১ সালের পহেলা জুলাই। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ, মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম স্থাপনা ও প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য কার্যক্রম শুরু করে তৎকালীন ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা রমনা সিভিল লাইনে ঢাকার নবাব পরিবারের দেওয়া ৬০০ একর জমি ও এর ভিতরে অবস্থিত মনোরম ভবনগুলো নিয়ে। তখন এই এলাকাসহ পুরো ঢাকা ছিলো সবুজে পরিপূর্ণ। সে সময় নানা রকম বিচিত্র বন্যপ্রাণীতে পরিপূর্ণ ছিলো এই এলাকাসহ পুরো ঢাকা।
কালের বিবর্তনে বদলেছে তিলোত্তমা নগরী ঢাকা। এখন সেই সবুজ ঢাকা ইট-কাঠের আস্তরণের পরিপূর্ণ। এ শহরে এখনও ১৮০ প্রজাতির অধিক পাখি, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীর দেখা মিললেও তাদের তুলনামূলক প্রাচুর্যতা অনেক কম। ঢাকা শহরে কিছু বিশেষ একলায় এই প্রাণিরা গুচ্ছকারে অবস্থান করছে। এর মধ্য জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, রমনাপার্ক, উত্তরা, দিয়াবাড়ি, খিলখেত, রামপুরার আফতাবনগর আর আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পসে গুচ্ছ আকারে অবস্থান করছে এই বন্যপ্রাণীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে ক্যাম্পাসে বিচরণকারী বন্যপ্রাণীদের নিয়ে করা বিস্তৃত গবেষণাটির একটি অংশ। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করেন। এতে সহকারি অধ্যাপক মো. মাহাবুব আলম, প্রভাষক মো. ফজলে রাব্বী, মো. মোখলেছুর রহমানসহ তত্ত্বাবধানে আমি সরাসরি মাঠ পর্যায়ে তিন বছর ধরে (মার্চ ২০১৭- ফেব্রুয়ারী ২০২০) গবেষণাটি পরিচালনা করি।
গবেষণাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, ক্যাম্পাসের সকল বন্যপ্রাণীর একটি ডেটাবেস তৈরি করা, তাদের সারা বছরের তিনটি প্রধান ঋতুর বৈচিত্র্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণসহ পরিবেশ ও প্রতিবেশ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। গবেষণাকালে দেখা যায়, পাঁচ প্রজাতির উভচর, দশ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭০ প্রজাতির পাখি, নয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিচরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এদের মধ্যে আবাসিক ও পরিযায়ী সকল ধরনের পাখি রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে শীত মৌসুমে সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণীদের দেখা মেলে। বন্যপ্রাণীর প্রজাতি সংখ্যা বেশি দেখা যায় তৃতীয় বছর অর্থ্যাৎ ২০১৯ সালে। আর প্রথম বছর অর্থ্যাৎ ২০১৭ সালে গণনা করা হয় সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণী। অবশ্য এরপরে ক্রমাগতই কমেছে এই সংখ্যা।
ব্যাঙের মধ্যে আছে কুনো ব্যাঙ, কোলা ব্যাঙ, ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ, লাউ বিঁচি ব্যাঙ আর গেছো ব্যাঙ ছিল উল্লেখ্যযোগ্য। বর্ষা মৌসুমে বেশিই দেখা মেলে এই ব্যাঙগুলো। বিশেষ করে বৃষ্টি হলেই সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মাঠ, প্রাঙ্গণ, জলাশয়, ঝোপঝাড় মুখরিত হয় ব্যাঙের ডাকে। কিন্তু উল্লেখিত তিন বছর ক্রমাগতই ব্যাঙেদের বৈচিত্র্য কমার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে নষ্ট হয়েছে ব্যাঙের আবাস ও প্রজননস্থল হওয়াই এর অন্যতম কারণ।
দশ প্রজাতির সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে- টিকটিকি, গিরগিটি, তক্ষক, অঞ্জন, সাপ, গুঁইসাপ ও কচ্ছপ জাতীয় প্রাণীরা। মাঠ পর্যায়ে এই গবেষণায় কোন বিষধর সরীসৃপ দেখা না গেলেও সম্প্রতি এই গবেষণা পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের চারুকলা ভবন এলাকায় একটি খৈয়া গোখরা সাপের খোলস পাওয়া যায়। এছাড়া ক্যাম্পাসের কার্জন হলের পুকুরে রয়েছে দুই প্রজাতির কচ্ছপ, এই পুকুরের আশেপাশে রয়েছে গুঁইসাপের বিচরণ।
পৃথিবীর সুন্দরতম সৃষ্টির মধ্যে পাখিদের ধরা হয় অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সবাই কাক আর চিল দেখলেও এই ক্যাম্পাসে বর্তমানে রয়েছে ৭০ প্রজাতির পাখি। যার মধ্যে নয় প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। ৭০ প্রজাতির পাখিদের একটি বড় অংশ প্রজনন করে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গাছ, কোটর, দেয়ালের ফাঁকা স্থানসহ বিভিন্ন অংশে। ঠিক ভোরে পাখিদের কলকাকলীতে তৈরি হয় এক অপূর্ব পরিবেশ।
পাখিদের মধ্যে টিয়া, চিল, ময়না, চড়ুঁই, বাতাসি, কাকের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। টিয়াদের সংখ্যাও বেশি থাকার কারণ ক্যাম্পাসে বিদ্যমান বিভিন্ন বুনো বড় গাছের সমাহার। চিলেরাও ব্যবহার করে এ সকল বড় বড় গাছ এবং ক্যাম্পাসে বিদ্যমান আছে বেশ কিছু ভুবন চিলের বড় কলোনীও। রয়েছে চার প্রজাতির টিয়া, চার প্রজাতির পেঁচা, দুই প্রজাতির চিল, দুই প্রজাতির মৌটুসী, দুই প্রজাতির মাছরাঙা, কালোমাথা বেনেবউ, দোয়েল, কোকিল, পাপিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, খয়রা হাঁড়িচাচা, সবুজ সুইচোরা, খঞ্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
পাখির বৈচিত্র্য নিয়ে গত দশ বছরে বিভিন্ন গবেষণা ও এই গবেষণাসহ ক্যাম্পাসে মোট গবেষণা হয় চারটি। যেখানে সর্বমোট ৯৬টি পাখির তথ্য পাওয়া গেছে। আগের গবেষণাগুলোতে পাওয়া ২৬টি পাখি এই গবেষণাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। তবে নতুন করে নয়টি পাখি দেখা গেছে, যা উল্লেখ ছিল না পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে।
নগরায়নের ফলে কিছু প্রজাতির প্রাণি উপকারভোগী হয়। কারণ এই সকল এলাকা অধিক পরিমাণ খাদ্য সরবরাহ এবং শিকারি প্রাণি থেকে রক্ষা পাওয়ায়। যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণিদের ক্ষেত্রে। তাই স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে ইঁদুর জাতীয় প্রাণি অধিক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া বেজি, বাঁদুর, চামচিকা, কাঠবিড়ালির দেখা মেলে; কিন্তু সংখ্যা খুবই সামান্য। আর মাঝে মধ্যে দেখা মেলে দু’একটি রেসার্স বানরেরও।
অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বা উঠছে নগর কাঠামো, আর এই নগরের বন্যপ্রাণীদের অবস্থা আগামীতে কেমন হবে তা মোটেও ভাবা হচ্ছে না। ফলে দ্রুতই নষ্ট হচ্ছে বুনো প্রাণিদের আবাসস্থল, হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। রাজধানী ঢাকা শহরে এখন মাত্র কয়েকটি অংশে টিকে থাকা বন্যপ্রাণীরাও যেন দিন গুনছে চির বিদায় নেওয়ার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ বন্যপ্রাণীবিদদের মতে, ৪০-৫০ বছর আগেও এখানে ছিল বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। কাঁটাবন এলাকা ছিল পুরোটাই জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশ ছিল সবুজ ও দেশিয় বৃক্ষে আচ্ছাদিত। খাঁটাশ, ভাম, শিয়াল দেখা যেত নিয়মিতই। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত ছিল, যা এখন সোনালী অতীত!
ঢাকা শহরে অবস্থিত এই ক্যাম্পাসে টিকে আছে বড় বড় শতবর্ষী বৃক্ষ। যা আজও আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে এই হাজারো বন্য প্রাণী ও পাখিকে। আর দেশি বিভিন্ন গাছের দেখা মেলে এই ক্যাম্পাসে,যা থেকে পাখিরা পায় খাদ্য। ঢাকার ছোট এই সবুজ ক্ষেত্রে এতো সংখ্যক বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি প্রমাণ করে এখনও এই শহরের বুকে বুনো জগতের স্পন্দন বিদ্যমান।
বুনো প্রাণীরাই পারে পুনরায় ইট-কাঠের এই শহরে ফিরিয়ে আনতে প্রাণের স্পন্দন। এজন্য দরকার যাথাযথ উদ্যোগ, প্রয়োজন ক্যাম্পাসে শোভাবর্ধক গাছের পাশাপাশি দেশিয় বুনো গাছ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রাণীদের সুরক্ষার বিষয়ে একটু ভাবনা ও উদ্যোগ। পাশাপাশি ক্যাম্পাসে সম্প্রতি বেড়েছে দূষণ, বিশেষ করে বায়ু ও শব্দ দূষণ এবং ছুটির দিনে অবাধ চলাচল ও অতিরিক্ত লোক সমাগম, যা প্রাণীদের নিরাপদ বিচরণের জন্য হুমকি।
বর্তমানে নগর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নগরে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বিশ্বজুড়েই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরো ঢাকার বুকে এক টুকরো সবুজ আচ্ছাদন। তাই সংরক্ষণ জরুরি এখানে টিকে থাকা প্রাণীদের। প্রাণের ভালোবাসায় বেঁচে থাকুক প্রতিটি প্রাণের স্পন্দন। আর জন্মদিনে শুভেচ্ছা প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রতি।