
আজকাল প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী হত্যা বা তাদের প্রতি সহিংসতার খবর পাওয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট প্রাণী ব্যাঙ থেকে বৃহৎ হাতি, কেউই যেন বাদ যাচ্ছে না! অথচ সব সময় আমরা উল্লেখ করি, জীব-বৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীতে সমৃদ্ধ এ দেশ। কিন্তু প্রশ্ন উঠে নির্বিচারে এতো হত্যা, বন নিধন বা আবাসস্থল ধ্বংসের পরও কতটুকু আদৌ টিকে আছে?
যদিও বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নানা আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করছে সরকার। কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ ও ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাবে যথাযথভাবে নিশ্চিত হচ্ছে না প্রাণির সুরক্ষা।
বিলুপ্ত প্রাণির তালিকায় হাতি?
ডাঙ্গার সর্ববৃহৎ এই প্রাণির আবাস ছিল এক সময় ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম বিভাগের বড় বনগুলোতে। কিন্তু কালক্রমে এখন বইয়ের পাতায় ছবি হওয়ার অপেক্ষায়। গত দুই বছরে মৃত্যু হয়েছে ৩৪টি হাতির। যদিও মৃত্যু বললে ভুল হবে, আসলে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে এ দেশের মহাবিপন্ন এই প্রাণিটিকে। যদি গত পাঁচ বছরের হিসেব করা হয় সংখ্যাটি ৭০’র বেশি। আর ২০১৬ সালের আইইউসিএন- এর তথ্যমতে হাতির সংখ্যা ২৬৮টি। এরপর এখন কতটি হাতি টিকে আছে এর সঠিক সংখ্যা অজানা।

বর্তমানে শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে ও সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা মেলে হাতির। কিন্তু মানুষ বন উজাড় করছে, হাতির চলাচলের পথে কাটাতার দিচ্ছে, পানির উৎস নষ্ট করছে, হাতির খাদ্যের উৎস নষ্ট করে ফসলের ক্ষেত তৈরি করছে, কিন্তু দোষটা দিচ্ছে হাতির উপর। হাতিকে বৈদ্যুতিক শকসহ বিভিন্ন পন্থায় করা হচ্ছে হত্যা। হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্বে মারা যাচ্ছে অসংখ্য হাতি। এভাবে আর কিছুকাল পরেই হয়তো প্রাণিটির জায়গা হবে শুধুমাত্র জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক আর বই’র পাতায়।
ঝুঁকিতে বুনো বিড়াল ও মাংসাশী প্রাণী
এমন একটি সপ্তাহ নেই যেখানে দু’একটি মেছো বিড়াল বা বাঘের মৃত্যুর খবর বা উদ্ধারের খবর না আসে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এবং গণমাধ্যমে কিছু খবর সামনে আসলেও বেশিরভাগ অজানা। অনেক ক্ষেত্রে নিশাচর এই প্রাণীদের মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এ দেশের কোন মহাসড়কই বন্যপ্রাণী পারাপারের উপযোগী করে গড়ে উঠছে নাহ। ফলে প্রাণ যাচ্ছে উপকারী বন্যপ্রাণীর। কিছুদিন আগেও একটি মর্মর বিড়াল নামে একটি প্রাণীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল চট্টগ্রামে। যে কিনা ইতিপূর্বে বাংলাদেশ মাত্র তিনবার দেখা গেছে।

এছাড়া এই প্রাণিগুলোর প্রতি মানুষের রয়েছে অহেতুক ভয়। যেমন: মেছোবাঘ, চিতা বিড়ালকে বাঘের বাচ্চা মনে করা; ভ্রান্ত ধারণা, যেমন: শিয়ালের চামড়ার বা মাংসের ঔষুধি গুণ; ভুল চিন্তা, যেমন: বিন্টুরং মৃত মানুষের কবর খুড়ে লাশ খায়, যার জন্য গত বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বিন্টুরং পিটিয়ে মারা হয়। এছাড়া মেছো বাঘকে বাঘ মনে করে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। মারা হচ্ছে চিতা বিড়ালকেও। বন্যায় শিয়ালের গর্ত পানিতে ডুবে। এ সময় প্রাণীগুলো আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের চারপাশে চলে আসে। আর মানুষ অমানবিকভাবে হত্যা করছে প্রাণীদের।
বিপন্ন বন্য ও লোকালয়ের নর-বানর
শহর অঞ্চলের আশেপাশে সাধারণত রেসার্স বানর, যশোরের হনুমানের বসবাস। কিন্তু শহরায়নের ফলে কমেছে তাদের আবাসস্থল, দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক খাদ্যের সংকট। তাই উপায় না পেয়ে প্রাণিগুলো ক্ষুধা মেটাতে হানা দিচ্ছে মানব বসতিতে। আসলে মানব বসতি বললে ভুল হবে। আসলে মানুষই প্রাণিগুলোর আবাসস্থানে গড়ে তুলছে নিজেদের বাড়ি-ঘর। বনের নর-বানরেরা যে ভালো আছে তা কিন্তু নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হলো কাকড়া ভূক বানর। বাকিরাও রয়েছে নানা সমস্যায় জর্জরিত।
পাখিরা হারাচ্ছে আবাসস্থল
গ্রাম হোক বা শহর, বর্তমানে ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে গাছপালার সংখ্যা। বুনো যে দেশজ গাছপালা ছিলো, যে গাছগুলোর ফল বুনো পাখিরা খেত কিংবা আশ্রয়স্থল ছিল সেগুলোর বেশিরভাগই এখন হারিয়ে গেছে ও যা অবশিষ্ট আছে তাও বিলুপ্তির মুখে। সরাসরি অর্থনৈতিক অবদান না থাকায় নতুন করে গাছগুলো আর রোপিত হচ্ছে না। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গাছগুলোকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা পাখিরা। আর শহর এলাকায় এর মাত্রা মারাত্মক।

লালসার শিকার জলচর পাখিরা
বন্যপ্রাণীর মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে জলচর পাখিরা। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও অর্থনীতি তে এদের ভূমিকা অনন্য। কিন্তু তবুও এই পাখিরা সারাবছর, বিশেষ করে শীত মৌসুমে অবৈধভাবে শিকার হচ্ছে মানুষের হাতে। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে এই পাখিদের সংখ্যা। বিশেষভাবে পরিযায়ী হাঁস, বগা- বগলা, শামুকখোল বা বড় বক জাতীয় পাখিরা শিকার হচ্ছে নিয়মিত। ফাঁদ, বিষটোপ ও বন্দুক ব্যবহার করে মারা হচ্ছে এই পাখিদের।
বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব এখনও সাধারণ মানুষের দুয়ারে তেমনভাবে পৌঁছায়নি। ফলে এখনও বিভিন্ন পাখিকে ক্ষতিকর মনে করে হত্যা করে মানুষ। গত বছর যেমন ফসলের ক্ষেতের পাশের বাবুই পাখিদের ধরে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ মানুষ ভেবেছিল এই পাখিরা তাদের ফসলের একটা বড় অংশ খেয়ে ফেলে। অথচ তারা অবগত না যে এই পাখিরা তাদের ফসলকে ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে। ঠিক তেমনই হত্যার শিকার হচ্ছে জলাশয়ের আশপাশের বা জলাশয়ের মধ্যে থাকা পাখিরা।
ভালো নেই জলজ জলজ স্তন্যপায়ীরা
এ দেশে এক সময় মিঠাপানির শুশুকের দেখা খুব সহজে পাওয়া গেলেও এখন আর সহজে দেখা যায় না। জলাশয়গুলো ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। আর নষ্ট হচ্ছে জলজ পরিবেশে। এখনও কোথাও কোথাও শুশুক ধরে বিক্রি হয়। আর বড় বড় নদীতে মাছের জালে আটকায় শুশুক। বিগত কয়েক বছরে সমুদ্রের পাড়ে মৃত তিমি বা ডলফিন ভেসে আসতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু এই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা এখনও সম্ভব হয়নি।

বাড়ছে মানুষ-সরীসৃপ দ্বন্দ্ব
অতি প্রাচীনকাল এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী বিশেষ করে সাপের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাস। যা এখনও বিরাজমান। দিন যত যাচ্ছে মানব জনসংখ্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে মানুষ হাত বাড়াচ্ছে বনের দিকে। খাদ্য চাহিদা পূরণে অধিক ফসলের জন্য নতুন জমি,নতুন আবাসস্থল, স্থাপনা সবকিছুই হচ্ছে প্রকৃতিক পরিবেশ কে বিনষ্ট করে।
অপরদিকে ঐ সকল অঞ্চলে বসবাস করা বন্যপ্রাণীরা হারাচ্ছে আবাসস্থল। উক্ত এলাকার সরীসৃপ জাতীয় প্রাণিরা যখন বিচরণ করে ঠিক তখনই মানুষ বলে, তাদের এলাকা বা বসতবাড়িতে হানা দিচ্ছে সাপ। আসলে প্রাণীরা তো বলতে পারছে না, যে এটা তাদের এলাকা, মানুষ উড়ে এসে জুড়ে বসে ধ্বংস করছে তাদের অধিকার।
এমন পরিস্থিতিতে তৈরি হচ্ছে মানুষ সরীসৃপ সংঘাত। বেশির ভাগক্ষেত্রেই মারা পড়ছে সরীসৃপ, কিছু ক্ষেত্রে মানুষ। মানুষের আবস্থলের আশেপাশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস। কিন্তু মানুষ অজ্ঞাতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারা পড়ে নির্বিষ সাপও। মারা যাচ্ছে পরিবেশের বন্ধু গুঁইসাপও।

হুমকিতে কচ্ছপ ও তক্ষক
প্রায়ই আসে তক্ষক বা কচ্ছপের পাচার ও আটকের সংবাদ। মানুষের ভ্রান্ত ধারণার কারণে তক্ষক প্রাণিটি এখন বিপন্ন। আর কচ্ছপের সংখ্যা তো কমতে কমতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে এ দেশের ৩০ প্রজাতির মধ্যে ২২ প্রজাতির কচ্ছপ এখন বিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
আবাসস্থল হারাচ্ছে উভচর প্রাণীরা
এ দেশের জলাশয় ও জলজ পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংসের পথে। প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশের গুণাগুণ হারিয়ে এখন দূষিত। পাশাপাশি ক্রমশ ভরাট হচ্ছে জলাশয়। জলাভূমি দূষণ, নগরায়ন, ফসলের ক্ষেতে কীটনাশকের অধিক প্রয়োগসহ বিভিন্ন কারণে আবাসস্থল সংকটে উভচর প্রাণীরা। ফলাফল স্বরুপ ক্রমেই কমছে কৃষকের নীরব বন্ধু এই প্রাণীর সংখ্যা।
লেখক: বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।