
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর লেখায় বার বার ফুটিয়ে তুলেছেন দোয়েল পাখির শিস, শ্যামার নরম সুরের গান, খঞ্জনার নৃত্য, সোনালী ডানার শঙ্খচিলের গল্পসহ এমন অনেক পাখির কথা। তবে বিভিন্ন লেখকদের গল্প, গান, কবিতা বা কাব্য উপন্যাসেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের পাখিরা। এক সময় এ দেশের গ্রাম বাংলার পরিবেশ নানা প্রজাতির পাখিতে ছিল বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু এখনও কেমন আছে সে গ্রামীণ পাখিরা?
বিশ্বে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ দেশে জনসংখ্যার স্ফীতি হয়েছে গত একশো বছরে। গত শতকের শুরুতে জনসংখ্যা ছিলো ২৯ মিলিয়ন সেখানে বর্তমানে ১৫২ মিলিয়ন। আর এই অধিক জনসংখ্যার জন্য দরকার অধিক খাদ্য,বস্ত্র-বাসস্থানসহ নানান মৌলিক চাহিদা পূরণ যার অধিকাংশ পূরণ হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস করে। আর ক্রমাগতই গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে বাড়ছে শহরের আয়াতন। আর মানুষ তার নিজের বাসস্থান তৈরী করতে ধ্বংস করছে অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থল।
চলুন গ্রামে ফিরে যাই, মনে করুন তো ছেলেবেলার গ্রামের কথা, সূর্যি মামা সোনারোদ ছড়িয়ে ঝিকিমিকি আলোয় জগৎকে আলোকিত করতো। আর সবুজ টিয়া পাখিরা বন্ধু ফুলকে ডেকে উঠাবে, কথা বলে উড়াল দিবে বহুদূরে। দূর গ্রামে মান্দার আর শিমুল গাছে ফুল ফুটেছে, ফল ধরেছে। সেথায় গিয়ে পৌঁছে দিবে এখানকার ফুলের গল্প।
আবার ওদিককার খবর নিয়ে ফিরবে এখানে। এইতো আলো ফোটার সাথে সাথে পেঁচা মশাই এর ঘুম ঘুম ভাব শুরু। তার সারা রাতের কীর্তি কলাপে ইঁদুর কূলের জীবন ওষ্ঠাগত। চুটকি, ফুটকিরা ডাকছে। আর দোয়েলের শীষে আর শ্যামার নরম সুরে মুখরিত চারিদিক। সকাল বেলার জানালার পাশেই মাচা করে লাগানো সিমগাছ। সিমফুলের মধুখেতে বেগুনী মৌটুসীরা। আর তার পাশে যে খেজুঁর গাছ,সেখানে চুপি চুপি রস খেতে এসেছে শ্বেতাক্ষী। তার জলপাই হলুদ রঙের দেহ আর চোখের পাশের সাদা বলয় মনেহয় তার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
পাশেই ছোট গাছটিতে বেনেবউ তার হলদে রঙে সঙ্গীকে খুঁজতে ডাকাডাকি করছে। এই সাত সকাল বেলা নীল গলা বসন্ত-বাউড়ির কান্ড দেখেছো। চুপিচুপি পেঁপে খেয়ে যাচ্ছে গাছ থেকে। হ্যাঁ। এটাই ছিলো আমাদের পল্লী বাংলার আঙিনা। সারাদিন বসে এখানে রঙের মেলা। হাজারো রঙের বর্ণোচ্ছটায়, বর্ণিল এক একটি দিন।
কিছুক্ষণ পর উঠোনে বসে লাল-ফড়িং, রাজা-ফড়িং সহ আরও ফড়িং এর মেলা, আর প্রজাপতির রঙিন ডানা ছড়ায় অপূর্ব মোহনীয়তা। বাড়ির পিছন দরজাটা খুললে যেন আরেক জগৎ। পুকুর পাড়ে বসে মহাধৈর্যশীল মাছরাঙা। সাথে লেজ ছড়িয়ে নাচে ছাতিঘুরানী। পুকুরে পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে গুইসাপ আর বেজী। মাঝে মধ্যে মধুবাজ এসে বসে লম্বা গাছটার মাথায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর। কোকিলের আর পাপিয়ার কুহু গানে আলস দুপুরে চোখজুড়ে নামে ঘুম। লম্বা লেজের সবুজ বর্ণের অপূর্ব পাখি সবুজ-ঠোট মালকোহা এলো এর মধ্যে। আর একদিকে ছোট পাখি হলে কি হবে, সারাদিন ধরে ডাকাডাকি করে বাড়ি মাথায় তুলছে টুনটুনি।
নামে সন্ধ্যা আমার আঙিনায়। বাড়ির পাশের জঙ্গলের রাতচোরার চাক-চাক-চাক ডাক শোনা যায়,আর পেঁচারা ঘুম ভেঙে ডাকা ডাকিকরে খবার সংগ্রহে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে দূর থেকে শেয়াল পন্ডিতের ডাক শুনতে পাই। এইতো বনবিড়াল টা গেলো ঠিক বাড়ির পাশ দিয়ে। এদিকে প্রকৃতির মরিচবাতি জোনাকিরা মিটি মিটি আলোদেয়। আর এমন আঙিনা নিয়ে দিন হাসি-খুশিতেই কেটে যেত।
এখন কেমন গ্রামগুলো?
আমরা নিজেরাও কি বলতে পারবো কবে আমরা জোনাকির আলো দেখতে পেয়েছি শেষ কিংবা কবে আমরা সেই বাহারি রঙয়ের প্রজাপতি ফড়িং দেখেছি। প্রজাপতির জন্য যে পোষক গাছগুলোর দরকার, সেগুলো তো দিনে দিনে কেটে উজাড় করে দেয়া হচ্ছে। ফড়িং যে পানিতে ডিম দিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করবে তাও হচ্ছে দূষিত। ফলে প্রতিবেশ ও পরিবেশ ব্যবস্থপনায় পড়ছে বিরূপ প্রভাব, বিঘ্নিত হচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলও। পোকাভূক পাখিরা হারাচ্ছে খাদ্যের উৎস।
এ দেশীয় তরু-পল্লব-বৃক্ষ কি আগের মতো আছে? বুনো ফলগুলো কি এখন আর পাওয়া যায়? গাব, বুনো আমড়া, ডেউয়া, লটকন, ডুমুর, বট, তালসহ বিভিন্ন গাছ ক্রমেই হারাচ্ছে গ্রাম থেকে। উল্লেখিত গাছগুলো কেটে গ্রামে এখন রোপিত হচ্ছে সরাসরি অর্থ ও ফলপ্রদানকারী দ্রুত বর্ধনশীল গাছগুলো। কিন্তু কেউ কি ওই বুনো গাছগুলো রোপণ করে? যা খেয়ে বুনো পশু,পাখিরা টিকে থাকবে? উল্টো ফল বাগান ও ক্ষেতে ব্যবহার করা হয় কারেন্ট জাল। এতে আটকে বছরে মারা যায় হাজারো পাখি। একদিকে তো প্রাকৃতিক খাদ্য সংকট অপরদিকে এভাবে অপমৃত্যু, কোথায় যাবে এই পাখিরা! তাই হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত প্রিয় এই দেশ থেকে।
গত বছর ঝালকাঠি এবং বরগুনাতে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল অসংখ্য বাবুই পাখি- অপরাধ ছিল ফসলের ক্ষেতের পাশে বাসা তৈরি করা এবং ক্ষেতের ফসল খাওয়া। অথচ বোকা মানুষেরা জানে না, এই পাখিগুলো কতশত পোকা খেয়ে ফসলের ক্ষেতকে পোকামাকড় মুক্ত রাখে, কাজ করে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে।
এ দেশের গ্রামীণ অঞ্চলে রয়েছে- বিল, ঝিল, হাওর, বাওড়, খাল-নদীসহ বিভিন্ন জলাশয়। এখানে বিচরণ করে বুনোহাঁস, সৈকত পাখি, বগা-বগলা, পিপি, মাছরাঙাসহ অনেক পাখি, সঙ্গে রয়েছে অনেক শিকারি পাখিও। কিন্তু ফাঁদ, বিষটোঁপ,এয়ারগান দিয়ে নির্বিচারে চলে এসব পাখিদের হত্যা। যদিও বিভিন্ন এলাকায় বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু খুবই দূরবর্তী গ্রামগুলোতে এখনও চলে এই প্রক্রিয়া।