এ কথা অনস্বীকার্য, দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার ছাড়া আজকের দুনিয়া অচল। এই মুহুর্তে যে পরিমাণ প্লাস্টিক তৈরি হয় এর ৭৫ শতাংশই বর্জ্য এবং এসব বর্জ্য যুগের পর যুগ নষ্ট হয় না; বিষাক্ত টেরেফথ্যালিক এসিড, মাইক্রোপ্লাস্ট ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়। প্লাস্টিক পোড়ালে স্টাইরিন বা ডাইঅক্সিনের মতো ‘কার্সিনোজেনিক’ (যা থেকে ক্যানসার হতে পারে) উপাদান তৈরি হয়।
পৃথিবীপৃষ্ঠ ভরে উঠছে প্লাস্টিক বর্জ্যে। নদী-নালা-খালের জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং মারাত্মক মাটি-পানি-বায়ু দূষণ ঘটিয়ে এসব বর্জ্য সমুদ্রে জমা হয়। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত ও হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বজুড়ে বছরে ৩০ কোটি লক্ষ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয় এবং প্রতি মিনিটে বিক্রি হয় ১০ লক্ষ প্লাস্টিকের বোতল। এর মাত্র ১৪ শতাংশ পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব আধুনিক প্রযুক্তিতে।
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন আজকের তুলনায় বাড়বে তিনগুণ। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতায় সবচেয়ে এগিয়ে একবার ব্যবহারযোগ্য বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। এই জাতীয় প্লাস্টিক ধীরে ধীরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত হয়ে মাইক্রোপ্লাস্ট রূপ নেয়। এসব মাইক্রোপ্লাস্ট পরবর্তীতে খাদ্য, জল বা প্রশ্বাসের সঙ্গে মানবশরীরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন কোষ অচল করে দেয়।
সাম্প্রতিক গবেষণামতে মানুষের রক্তেও এখন মাইক্রোপ্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। প্লাস্টিকের মধ্যে পাওয়া PFOA/PFAS, BPA, Phthalates ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব মানব-স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় যা মানুষের ধারণারও বাইরে। গত বছর প্রকাশিত সুইস ইউনিভার্সিটির দীর্ঘ আড়াই বছরের গবেষণা রিপোর্ট বলছে প্লাস্টিকের মধ্যে সনাক্তকৃত দশ হাজার ৫০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থের সরাসরি এক চতুর্থাংশ জলজ প্রাণি ও পরিবেশের জন্য বিষাক্ত এবং মারাত্মক ক্ষতিকর।
পরিবেশ ও মানুষ, উভয়ের পক্ষেই প্লাস্টিক বিপজ্জনক। ফলে স্বাস্থ্যহানি, প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগসৃষ্টি তথা মানবসভ্যতা বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এই মাস থেকে ভারতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করা হয়েছে। সেখানকার পরিবেশ মন্ত্রকের জারি করা নির্দেশিকা অনুযায়ী, এক্সপ্যাণ্ডেড পলিস্টিরিন, পলিস্টিরিন সহ যে কোনও সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের উৎপাদন, বিক্রি, আমদানি, বিতরণ নিষিদ্ধ করা হবে। ফলে এক বার ব্যবহারের প্লাস্টিকে তৈরি মিষ্টির বাক্স, কাপ, চামচ, ছুরি, বাটি, সিগারেটের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাঠি- সবই নিষিদ্ধ তালিকায় পড়বে।
সাধারণত ৭৫ মাইক্রনের বেশি মাপের প্লাস্টিককে পুনর্ব্যবহার করে নতুন কিছু তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ৫০-৬০ মাইক্রনের প্লাস্টিককে পুনর্ব্যবহার্য করে তোলা যায় না। কারণ, তা আর্থিক ভাবে লাভজনক হয় না। তাই ওই প্লাস্টিক বর্জ্য ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে, নির্দিষ্ট মাপে কেটে বিটুমিনের সঙ্গে মেশানো হয়। ভারতে বিটুমিন বা পিচের তৈরি রাস্তার উপরিভাগের মিশ্রণ তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বর্জ্য প্লাস্টিক। সেখানে ২০২০ সালে ৭৫ মাইক্রনের নিচের প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার (পলিথিন) নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো এবং এ বছরের ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ১২০ মাইক্রন করা হবে।
বাংলাদেশের চিত্র
একমাত্র ভালো দিকটি হচ্ছে, বাংলাদেশ প্লাস্টিক কাঁচামালের (পলিমার) জন্য সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর। পলিমার উৎপাদন বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ ভাবনা করতে হয় না। বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে অনুযায়ী ২০০৫ সালে দেশে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ৩.১ কেজি ও ঢাকা শহরে ৯.২ কেজি ছিলো। যা ২০১৪ সালে বেড়ে যথাক্রমে ৩.৫ ও ১৬.২ কেজি এবং ২০২০ সালে যথাক্রমে ৯ ও ২৪ কেজি দাঁড়ায়। অর্থাৎ ২০০৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পনেরো বছরে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে তিনগুণ।এ দেশে ২০১৪ সালেই দিনে কমপক্ষে ২৭০০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হতো। ব্যবহার বছরে বছরে বাড়ছে। এ হার চলতে থাকলে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দাঁড়াবে প্রতিদিন ৫০ হাজার টন।
এ দেশে এখন দিনে ব্যবহৃত হচ্ছে এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ। পলিথিনের বিকল্প হিসাবে টিস্যু ব্যাগ নামে যে ব্যাগের ব্যবহার শুরু হয়, সেটার উপাদানও মূলত প্লাস্টিক। পলিথিন ব্যাগের পাশাপাশি বাংলাদেশে বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন ব্যবহার হয় ৩০ লাখেরও বেশি টিস্যু-ব্যাগ। অথচ এ দেশে ২০০২ সালে পলিথিন উৎপাদন বন্ধ সংক্রান্ত আইন করা হয়। যা দুই দশকেও দেখেনি কার্যত আলোর মুখ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় সামুদ্রিক লবণে অর্থাৎ প্যাকেটজাত লবণ ব্র্যান্ডে নমুনার প্রতিকেজিতে দুই হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক (প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র-কণা) সনাক্ত হয়েছে। এসব কণার মূল উৎস হিসেবে সৈকতে যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য দায়ী। এ হিসেবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বছর গড়ে গ্রহণ করে থাকে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক। সমুদ্র সৈকতে যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এবং নানা কারণে সেসব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চলে যাচ্ছে পানিতে। সামুদ্রিক লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মূলত সেটাই প্রধান উৎস।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী-বিষয়ক সাময়িকী ‘এনভায়রনমেন্টাল অ্যাডভান্সেস’-এ ২০২১ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশে এটিই এ ধরনের প্রথম গবেষণা। দূষণের এই তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ক্রোয়েশিয়া, দ্বিতীয় স্থানে ইন্দোনেশিয়া এবং তারপরেই বাংলাদেশ। এর আগে বিজ্ঞানীদের এই দলটি দেশি মাছের ওপর গবেষণা চালিয়ে সেগুলোর পেটের ভেতরেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।
অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে- এ দেশের প্রধান সমস্যা প্লাস্টিক বর্জ্যর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতার অভাব, প্লাস্টিক উৎপাদন, বণ্টন ও বিপণন সংক্রান্ত দুর্বল পলিসি এবং সময়োপযোগী কার্যকর আইন। এজন্য ব্যক্তিগত ও সরকারি, দুটোই সমান জরুরি। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে পারলে তো মানুষেরই লাভ। আত্মসচেতনতা ও মূল্যবোধ যদি জাগ্রত না হয়, তাহলে সম্ভব নয় এই দূষণ রোধ ঠেকানো।