প্রকৃতি ও মানুষের অনন্য বন্ধু শামুক

শামুক। ছবি: সংগৃহীত

শামুকের শরীরে রয়েছে প্রাকৃতিক জলশোধন ব্যবস্থা বা ফিল্টার। এরা ময়লাযুক্ত পানি পান করে। এতে ময়লা খাদ্য হিসেবে খেয়ে বিশুদ্ধ পানি বাইরে ছেড়ে দেয়। গবেষকরা বলেন, যে জমিতে শামুক থাকে, সেখানে উর্বরতা ও ফলন বেশি হয়। অগোচরে কৃষকের বন্ধুর ভূমিকা পালন করে শামুক।

শামুক ও এর ডিম ইঁদুরের প্রিয় খাবার এবং অল্পতে ক্ষুধা নিবারণ করে। জমিতে প্রচুর শামুক থাকলে ক্ষেতের ফসলও কম নষ্ট হয়। কই, শোল, শিং ও কার্পজাতীয় দেশি মাছগুলো শামুক ও শামুকের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকে। ফলে শামুক কমে গেলে পানি নষ্ট হয়, মাছ মরে যায়। অনেক ক্ষেত্র পানির রঙ পরিবর্তন হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। ফলে পানিতে রোগ-জীবাণু বাড়ে।

সম্প্রতি শামুক কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান নিয়ে এক গবেষণাপত্রে উঠে আসে এসব তথ্য। গবেষণাটি করেন শেখ তানজির আহমেদ ও আসাদুল ইসলাম নামের দুই তরুণ। এটি পরিচালনা করে সাতক্ষীরা বারসিক (বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইনডিজিনাস নলেজ) ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লাইড স্টাডিজ।

গবেষকরা জানান, দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণা করা হয়- প্রকৃতির বন্ধু হিসেবে শামুককে কতটা চেনে মানুষ ও এর বিলুপ্তির কারণ কী।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শামুকের উপকারিতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই সাতক্ষীরার ১৮ শতাংশ মানুষের। তবে প্রত্যক্ষ ধারণা আছে ৮২ শতাংশের। অর্থাৎ শামুক থেকে উপকার পায় তারা। যেমন- হাঁস-মুরগির খাবার, ঘেরে মাছের খাবার,  চুন তৈরিতে ব্যবহার হওয়াতে শামুক বিক্রি করে বা শামুক ভেঙে জীবিকা অর্জনকে বোঝে। আর এই ৮২ ভাগের মধ্যে ৫৮ ভাগ মানুষ পরোক্ষভাবে শামুককে পরিবেশের বন্ধু ভাবেন। এক্ষেত্রে পানি পরিষ্কারক, পানির মিষ্টতা পরীক্ষা, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, রোগের ওষুধ, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্য হিসেবে শামুক প্রাকৃতিকভাবে ভূমিকা রাখে বলে মনে করে তারা।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, সাতক্ষীরার ৮ শতাংশ মানুষ মনে করে শামুক কমে গেলে কোনো ক্ষতি হয় না। আর ৩ শতাংশ মানুষ ক্ষতি সম্পর্কে জানে না। বাকি ৮৯ শতাংশ মানুষের মতে, শামুক কমে যাওয়ার কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এতে মাছ ও হাঁসের খাদ্য কমে যাওয়া, পানি নষ্ট হয়ে যাওয়া, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়া, পানিতে রোগ-জীবাণু বৃদ্ধি, ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যাওয়া, দেশিয় মাছ কমে যাওয়াসহ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার কথা উল্লেখ করেন তারা।

ঘের মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী শামুক চাষে উৎসাহিত করা, ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, প্রজনন মৌসুমে (জুন-আগস্ট) শামুক ধরা নিষিদ্ধ, কেউ যাতে অন্যের জলাশয়ের শামুক ধরতে না পারে সেজন্য সাইনবোর্ড স্থাপন, সরকারের কৃষি বা মৎস্য বিভাগের সাইনবোর্ডগুলোতে শামুকের উপকারিতা তুলে ধরা, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণসহ জনসচেতনতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয় গবেষণাপত্রে।

সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক ওলিউর রহমান বলেন, শামুক দেহ থেকে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশজাতীয় বস্তু মাটিতে ছাড়ে। এরা মরে গেলে মাংস পচে ও খোলায় মাটিতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশজাতীয় সার তৈরি করে মাটি উর্বর করে।

তিনি জানান, ম্যাচোফেলিয়া ও মাইক্রোফেলিয়া নামের দুটি কীট খেয়ে বেঁচে থাকে শামুক। এই কীট দুটি ধান গাছের ক্ষতিকারক পোকা নষ্ট করতে সহায়তা করে। এতে ফসলের উৎপাদন বাড়ে। পরিবেশের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় শামুক ভূমিকা পালন করে। এরা না থাকলে পানির প্রাকৃতিক শোধন ক্ষমতা কমে যায়। এটা নিধনের ফলে কৃষিজমি ও পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) জাহিদুল কবির বলেন, ২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রকাশিত সরকারি প্রজ্ঞাপনে শামুককে বন্য প্রাণী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ধারা ৬ ও ৩৪-এ বলা হয়েছে, অনুমতি ছাড়া বন্য প্রাণী শিকার, ওঠানো, উপড়ানো ও ধ্বংস বা সংগ্রহ করা যাবে না।

“শামুক কেনা-বেচা বা আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না। এ নিয়ম না মানলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য এক বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। তাই শামুক ধরা ও বাজারজাত করা সম্পূর্ণ অবৈধ,” উল্লেখ করেন জাহিদুল কবির।