সংরক্ষিত বনে সড়ক ও বিদ্যুতের লাইন না করার দাবি

হাজারীখীল বনাঞ্চল। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান ও হাজারীখিল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে সড়ক ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে চায় সড়ক ও বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু এই বনাঞ্চল দু’টি রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও বনছাগলসহ কয়েক প্রজাতির বন্যপ্রাণী।

বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের বুক চিড়ে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ করতে চায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এতে অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।

জানা গেছে, ‘সীতাকুণ্ড-হাজারীখিল-ফটিকছড়ি’ প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় সড়কটি বারৈয়াঢালা উদ্যানের পাশাপাশি লাগোয়া হাজারীখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যের মাঝখান দিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে নকশায়। একটি সংরক্ষিত বন, অন্যটি বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য।

সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ বা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেয়ার বাধ্যতামূলক। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সওজ অধিদপ্তর।

দুটি সংরক্ষিত এলাকার মাঝ দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করা হলে সেখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। ফলে প্রস্তাবিত সড়কটির বিষয়ে আপত্তি জানায় বন বিভাগ।

এদিকে সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে সড়ক ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ না করতে গতকাল শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) বগুড়ায় মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদী সংগঠন তীর- এর সহয়োগিতায় মানবন্ধনে অংশ নেয় বাংলাদেশে জীববৈচিত্র সংরক্ষণ বিবিসিএফ।

শিক্ষার্থীরা বলেন, বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে দুই প্রকল্প বাস্তবায়রন হলে ঝুঁকিতে পড়বে সেখানকার দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণীরা। জীব বৈচিত্রের রক্ষায় সরকারকে এমন প্রকল্প থেকে সরে আসার আহ্বান জানায় তারা।

তবে সওজ অধিদপ্তরের দাবি, ৯ কিলোমিটারের সড়কটি নির্মাণ হলে ঢাকা থেকে পার্বত্য জেলায় যাতায়াতে ৭০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। সেইসঙ্গে ওই অঞ্চলে যোগাযোগ ও পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এটি নিয়ে এখন মুখোমুখি বন বিভাগ ও সওজ অধিদপ্তর।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলায় বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট খৈয়াছড়া, সোনাইছড়ি, লবণাক্ষ, নাপিত্যাছড়া, রূপসীসহ বেশ কয়েকটি ঝরনার উৎসস্থল। বিলুপ্তপ্রায় বনছাগলের বিচরণক্ষেত্রও এই জাতীয় উদ্যান।

বারৈয়াঢালা উদ্যান দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যের আধার। ওই অভয়ারণ্যে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১০৭ প্রজাতির পাখি, আট প্রজাতির উভচর, ২৫ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী এবং ২৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। বনছাগলের অন্যতম আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত এই অভয়ারণ্য। হরিণ ও মেছোবাঘও দেখা যায় সেখানে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বন বিভাগ জানায়, দুটি সংরক্ষিত বনের বুক চিড়ে সড়কটি নির্মাণ করা হলে সেখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।

বন বিভাগ জানায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই উপজেলার মধ্যে দুই হাজার ৯৩৪ হেক্টর বনভূমিতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০১০ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বারৈয়াঢালাকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। অন্যদিকে ফটিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত দুই হাজার ৯০৮ হেক্টরজুড়ে অবস্থিত হাজারীখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালে। ১৯২৭ সালের সংশোধিত বন আইন এবং ২০১২ সালের বন্য প্রাণী আইনে সংরক্ষিত বনে যেকোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা না করার নির্দেশ দেয়া হয়। কেউ করলে সেটি আইনগত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

চট্টগ্রামের বন সংরক্ষক মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল বলেন, হাজারীখিল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য হলো বন্য প্রাণীর আধারস্থল। সেখানে অনেক জীববৈচিত্র্য রয়েছে। দুই সংরক্ষিত বনের মাঝখান দিয়ে সড়কটি নির্মাণ হলে জীববৈচিত্র্য অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। বিলুপ্তপ্রায় সাইকাস উদ্ভিদ বিলীন হয়ে যাবে। সেখানে সাত থেকে আটটি ঝর্না আছে।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক ঝরনার পানির অবিরাম উৎসস্থল শুকিয়ে দিয়ে সড়কটি নির্মাণ করা হবে। অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবদুল আউয়াল বলেন, যখনই সংরক্ষিত বনে সড়ক নির্মাণ হয়েছে, এরপরেই বনের জমিতে অনুপ্রবেশ বেড়ে গেছে। বনের জমি জবরদখল বেড়েছে। গাছ চুরি বেড়েছে। এখানেও তা-ই হবে। সড়কটি নির্মাণ হলে মানুষের যাতায়াত বাড়বে। বনের ভেতর অবৈধ দোকানপাট গড়ে উঠবে।