দিনের পর দিন তরল বর্জ্য ফেলে হালদা নদী দূষণ করে আসছিল হাটহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যা বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে। তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা না করে সরাসারি বর্জ্য নদীতে ফেলার প্রমাণও পেলো পরিবেশ অধিদপ্তর।
গেলো ৮ জুলাই (সোমবার) পরিদর্শন করে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের প্রমাণ পায় পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি টিম। দেখা যায়, হাটহাজারী পৌরসভার ১১ মাইল এলাকায় অবস্থিত ১০০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের বর্জ্য উত্তর পাশের ছড়া দিয়ে চানখালী হয়ে অংকুরিঘোনা এলাকায় গিয়ে সরাসরি হালদায় পড়ছে। প্ল্যান্টের উত্তরপাশের ছড়া দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী খালে ফার্নেস অয়েলযুক্ত পানি নির্গত হয়। পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের অভ্যন্তরে তিন স্তরবিশিষ্ট ড্রেনেজ সিস্টেমের নিচের স্তর দিয়ে তেলমিশ্রিত পানি নির্গত হয়, যা আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপলাইনের সঙ্গে যুক্ত। ফার্নেস অয়েলযুক্ত পানি সরাসরি হালদার পানিতে মিশছে। আর বৃষ্টি হলেই সুযোগ বুঝে বর্জ্য ফেলার কাজটি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় আগামি ১৭ জুলাই পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ে শুনানি হবে। এতে হাজির হতে হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ম্যানেজার বরাবর নোটিশ ইস্যু করেছেন পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আজাদুর রহমান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে,পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ১২ ধারা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং কাজ শেষে পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অবস্থানগত ছাড়পত্র অথবা পরিবেশগত ছাড়পত্রের কোনটিই গ্রহণ করা হয়নি যা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১৫ ধারার বিধানমতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এ অবস্থায় পরিবেশ ও প্রতিবেশের দূষণের দায়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে পরিবেশ অধিদপ্তর। হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপককে তিন কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জবাব দিতে এবং একইসঙ্গে অনতিবিলম্বে ছাড়পত্র গ্রহণেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। অভিযোগের বিষয়ে নোটিশ দেয়ার পর পাঁচ মাস পার হলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ তখনও ছাড়পত্র সংগ্রহ না করলে ২০১১ সালের মে মাসে হালদা দূষণের দায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। অনেক শুনানির পর একসময় মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু হালদা নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে জরিমানা আদায়ের পরেও বর্জ্য শোধনাগার গড়ে তোলেনি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র।
হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমিন নিজ ফেসবুকে লিখেন, আমি বিদ্যুৎ চাই হালদাও চাই। এভাবে হালদা দূষণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন হালদাকে শেষ করে দিবে। ইটিপি বানানোর কথা, সেটাও নাই। বৃষ্টি মানেই হালদায় বজ্য ফেলে দেয়া। রাতের অন্ধকারে প্রশাসনের চোখ ফাকি দিয়ে হালদায় পোড়া ফার্নেস ওয়েল ছেড়ে দিলে ইউএনও একা ঠেকাতে পারবে না।
হালদা রিসার্চ সেন্টারের সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা বিষয়ে অনেকদিন ধরে আমরা হাটহাজারী ১০০ মেঘাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের এ অনৈতিক কাজ সম্পর্কে অভিযোগ করে আসছি। এবার হাতেনাতে ধরা পরেছে। সরকারী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিবেশ বিরোধী এই কর্মকান্ড অনভিপ্রেত।
‘গত বছর হালদাতে যে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে,তাতে সরকারের কাছে দেয়া প্রতিবেদনে আমরা পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃক হালদা দূষণের কথা বলেছি’ উল্লেখ করেন তিনি।