বিশ্বব্যাপী প্লাষ্টিক বর্জ্য নির্মুলে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছে যখন। ঠিক তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে নিজ দেশের প্লাষ্টিক বর্জ্য পাঠাচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। রীতিমতো এক অনুসন্ধানী সংবাদ প্রচার করে আমেরিকার গোমট ফাঁস করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ান।
গার্ডিয়ানের সংবাদে বলা হয়েছে, জাহাজে করে মার্কিনীদের ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে পাঠানো হয়ে থাকে। বিশ্বের ১১টি দেশে গার্ডিয়ানের সাংবাদিকদের করা অনুসন্ধান থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জানা গেছে, বছরে হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো হয়। কারণ ওই দেশগুলোতে শ্রমের মূল্য কম হওয়ায় পুনর্ব্যবহারের মার্কিন প্লাস্টিকের গন্তব্য এসব দেশেই হচ্ছে। এতে দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশে গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহতা কমাতে গেলো মে মাসে ১৮৭টি দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী, সহজেই রিসাইকেল বা পুনব্যবহার করা যায় না এমন প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হয় দেশগুলোকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। ২০১৮ সালে ৬৮ হাজার শিপিং কনটেইনারের সমপরিমাণ আমেরিকান প্লাস্টিক বর্জ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। ওদিকে নিজেদেরই প্লাস্টিক বর্জ্য সামলাতেই হিমশিম অবস্থা দেশগুলোর; তখন মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্যও বাড়তি বোঝা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের গন্তব্য ছিল চীন। কিন্তু দেশটি মার্কিনী প্লাস্টিক বর্জ্য নিষিদ্ধ করলে দরিদ্র দেশগুলোর উপর নজর পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে বাংলাদেশ, লাওস, ইথিওপিয়া এবং সেনেগালে রপ্তানীর মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে প্লাষ্টিক বর্জ্য। তুরস্কের মত কিছু দেশেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্যে এসব দেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে।
সংবাদমাধ্যমটির তথ্যানুযায়ী, বছরে ৩৪.৫ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে যুক্তরাষ্ট্র। যা দিয়ে দেশটির টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টন অ্যাস্ট্রোড্রাম স্টেডিয়ামটি এক হাজার বার ভরাট করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্লাস্টিক বর্জ্যের অর্ধেকের বেশি চীন এবং হংকং এ রিসাইকেল করা হতো। এসব বর্জ্য রিসাইকেল তথা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য চীন এবং হংকং এ বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছিল। চীনারা মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করে তা দিয়ে প্লাস্টিকের নতুন পণ্য তৈরি করতো। এসব পণ্য পশ্চিমা দেশে রপ্তানি করা হতো। কিন্তু মার্কিনীদের ফেলা দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য বেশিরভাগ সময়ই দূষিত ছিল কিংবা তা রিসাইকেল করার মত ছিল না। ফলে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে চীনের বেশিরভাগ অঞ্চলই আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য নিয়ে চীনাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে ২০১৭ সালে চীন সরকার পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য ছাড়া বেশিরভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যই দেশটিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য চীনের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এসব বর্জ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে পিংপং বলের মত ঘুরতে থাকে। শিপিং রেকর্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর রপ্তানি ডাটা বিশ্লেষণ করে গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো প্রতি বছর ১ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জাহাজে করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে থাকে।
জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে মার্কিন প্লাস্টিক বর্জ্যের বৃহত্তম গ্রহীতা মালয়েশিয়া নিজ দেশের প্লাস্টিক বর্জ্যের শতকরা ৫৫ ভাগ ঠিকমত ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না। এর অর্থ হলো এসব বর্জ্য ঠিকমত রিসাইকেল না করে গর্ত করে ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে। অপরদিকে ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনামও নিজেদের প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারছে না। এক্ষেত্রে দেশ দুটি যথাক্রমে শতকরা ৮১ এবং ৮৬ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্যের ভুল ব্যবস্থাপনা করছে।
মূলত প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের দালালরা বিদেশে এমনসব ক্রেতার সন্ধান করে যারা প্লাস্টিক গলিয়ে, এগুলোকে টুকরো করে নতুন কোন পণ্য তৈরি করতে পারে। হংকংভিত্তিক রিসাইক্লিং ব্যবসায়ী স্টিভ অং জানান, যদি সঠিকভাবে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং সঠিকভাবে করতে পারে না তবে তা পরিবেশ ধ্বংস করে দেবে। তবে এক্ষেত্রে মুনাফার দিকটাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি কোন দেশ থেকে যদি প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করা যায় তাহলে এই শিল্পের মুনাফা আরো বেশি হবে।
তিনি বলেন, কিছু দেশে প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহারের কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকার কারণে তারা চোরাচালানির মাধ্যমে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে। এমনকি এটা অবৈধ জানা সত্ত্বেও তারা প্লাস্টিক সংগ্রহের জন্য এখনো এই পথেই হাঁটছে।’
আগেই বলা হয়েছে চীন যখন সস্তা এবং দূষিত প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে তখন যুক্তরাষ্ট্রের এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয় মালয়েশিয়া। ২০১৮ সালের প্রথম ১০ মাস যুক্তরাষ্ট্র ১ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং করার জন্য মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিল।
ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন সুবিক বে’তে (যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনা ঘাঁটি) প্রতি মাসে ১২০টি শিপিং কন্টেইনারে করে প্লাস্টিক বর্জ্য পাঠানো হয়। রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, এসব কন্টেইনারে করে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, জর্জিয়া এবং পোর্ট অব নিউইয়র্ক-নিওয়ার্ক থেকে প্লাস্টিকের বর্জিতাংশ পাঠানো হয়েছে।
চীনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে তুরস্কে প্লাস্টিক বর্জ্যের আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। দুই বছরের মধ্যে এই আমদানি ১ লাখ ৫৯ হাজার টন থেকে একলাফে বেড়ে ৪ লাখ ৩৯ হাজারে পৌঁছায়। প্রতি মাসে এসব সস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য ১০ টি জাহাজে করে তুরস্কের ইস্তাম্বুল এবং আদানা বন্দরে আনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অ্যান্ড্রু স্পাইসার বলেন, ‘নিজেদের বর্জ্য নিয়ে কি হচ্ছে সে ব্যাপারে মানুষ কিছুই জানে না। আন্তর্জাতিক রিসাইক্লিং বাণিজ্য এটিকে অর্থ তৈরির একটি উপায় হিসেবেই দেখছে। এই ব্যাপারে বৈশ্বিক কোন নিয়ম নীতি নেই। কেবলমাত্র দীর্ঘ, নোংরা একটি মার্কেট রয়েছে। আর এই মার্কেট কেবলমাত্র কিছু কোম্পানিকে নিয়ম নীতিহীন এই বাণিজ্যের ফায়দা নেয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
সম্প্রতি পরিবেশবাদী গ্রুপ গাইয়ার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্লাস্টিক বাণিজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে স্থানান্তরের ফলে এসব দেশের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা দূষিত হয়ে পড়েছে, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে স্থানীয় জনগণ শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এসব দেশগুলো এবং তাদের জনগণ এই দূষণের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত মূল্য বহন করছে। সম্ভবত তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও তা করতে হবে।