অর্থনীতির কারিগর পরিযায়ী পাখিও

পরিযায়ী পাখির ছবি তুলেছেন লেখক।

হাজারো রঙের বর্ণচ্ছটায় অপরূপ সুন্দর সাজে সুশোভিত পৃথিবী। আর এই সুন্দরতম অংশের একটি হলো পাখি। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় প্রকৃতির এই অনন্য সৃষ্টি। পাখিদের মধ্যে একটি দল পরিযায়ী হিসেবে পরিচিত। যারা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চল, এক দেশ থেকে অন্য দেশ এমনকি এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পরিযান করে ঋতু ও কাল ভেদে।

বিশ্ব পরিবেশের ভারসম্য বজায় রাখাসহ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখছে পাখিগুলো। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পরিযায়ী পাখিরা হুমকির মুখে। ক্রমাগত কমছে তাদের সংখ্যা আর তারা সম্মুখীন হচ্ছে নানা প্রতিকূলতার। পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতেও পরিযায়ী পাখিরা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা।

পরিযায়ী পাখিরা পরিবেশের একটি নির্দেশক হিসাবে কাজ করে। একটি পরিবেশ কতটা ভালো অবস্থায় রয়েছে তা নির্দেশ করে কি পরিমাণ পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটেছে ওই এলাকায়। যে স্থানে যত বেশি পরিযায়ী পাখিরা আসবে এবং স্বাচ্ছন্দে থাকবে, সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ততটা ভালো। আর এর বিপরীত ঘটনা নির্দেশ করে সেই স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত।

বর্তমানে বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির আগমনের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশও। এ দেশে প্রায় ৭০০’র অধিক প্রজাতির পাখি রয়েছে। যার মধ্যে সাড়ে ৩০০’র মতো পরিযায়ী। এরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় বাংলাদেশে পরিযান করে আবার অন্য কোন দেশে পরিযান করে। খাদ্য, ঋতু ও তাপমাত্রাসহ প্রভৃতি নিয়ামক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এক্ষেত্রে। আর পরিযান শুধু শীতে ঘটে তা নয় সারা বছরই ঘটে থাকে। আর এই পাখিগুলো এ দেশের অর্থনীতিতেও রেখে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। যা আমরা হিসেবের বাহিরে রাখছি।

পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে যারা জলচর, বিশেষ করে জলজ প্রাণী ও মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে তারা সর্বদা অসুস্থ মাছ খেয়ে থাকে। আর এই মাছগুলো সংক্রমক রোগে আক্রান্ত থাকে। অসুস্থ মাছগুলো পাখি খেয়ে ফেলার কারণ মহামারিজনিত রোগ ছড়িয়ে পড়া থেকে রক্ষা পায় জলাশয়গুলো। জলাশয়ের পানির গুণগত মান ও সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করে পরিযায়ী পাখিরা। এদের নিয়মিত চলাচলে পানির পরিবেশ ঠিক থাকে ও জলজ উদ্ভিদ সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে।

পরিযায়ী পাখিদের একটি অংশ পোকা খেয়ে থাকে। এরা ফসলি জমির পোকামাকড় খেয়ে থাকে। ফলে ক্ষেতের ফসল বিনষ্টকারী পোকাগুলো পাখিরা খেয়ে কৃষি অর্থনীতিতেও রাখছে আরেক ভূমিকা।

পরিযায়ী পাখিদের আরেকটি অংশ শিকারি পাখি। যারা মাঠ-প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। আর ইঁদুর জাতীয় প্রাণি খেয়ে থাকে, যা কৃষকের ফসলের ক্ষতি করে থাকে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে- একটি পেঁচা পুরো জীবনে ইঁদুর খেয়ে ২০ লাখ টাকার ফসল রক্ষা করে। এছাড়া শিয়াল, বেজি ও গুইসাপের ক্ষেত্রেও এমনটাই প্রযোজ্য।

হাওড়-বাওড়ের জলচর পাখিরা কৃষি অর্থনীতি এবং মাছ উৎপাদনেও ভূমিকা রাখছে। প্রতিদিন প্রায় এক টন পরিমাণ বিষ্ঠা নির্গত করে পরিযায়ী পাখিরা। যা জলাভূমিতে জৈব সার হিসেবে কাজ করে। একদিকে মাছের খাদ্য হিসেবে ভূমিকা রাখছে এবং মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃদ্ধি করছে জলাশয়গুলোর চারপাশের জমির উর্বরতাও। ফলে ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিযায়ী পাখিদের একটি অংশ এ দেশের বিভিন্ন বন-বনানীতে আসে। বনের বিভিন্ন স্তরের খাবার খায়, যারমধ্যে থাকে উদ্ভিদের ক্ষতিকর পোকামাকড়। যা উদ্ভিদের অনিষ্ট করে থাকে। যা এ দেশের বনজ সম্পদ রক্ষায় অনন্য অবদান রাখে তা আমরা আমলেই রাখি না। একইসঙ্গে পরিযায়ী পাখিদের একটি অংশ আবর্জনা ভূক বা মৃতভোজী। বিশেষ করে শকুন। এরা পঁচা গলা প্রাণী আর ময়লা আবর্জন খেয়ে, বিভিন্ন রোগের জীবানু নষ্ট করে।

প্রতিবছর এ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে শীতকালে বসে হাজারো পরিযায়ী পাখির মিলন মেলা।  আর এই পাখিদের দেখতে দেশ-বিদেশ থেকেও ছুটে আসেন পর্যটকের দল ও আলোকচিত্রীরা। ফলে যে এলাকায় পাখি আসে সেখানে গড়ে ওঠে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ।

বলা চলে, পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে ভূমিকা রাখছে তা হিসেবের বাইরে থাকছে। সঠিক গবেষণা, পরিসংখ্যান ও হিসেব করা গেলে তা দেশের অর্থনীতির ও জিডিপিতে ‍উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে থাকবে।

প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে এখন ভালো নেই। বিচরণক্ষেত্র ধ্বংস ও শিকারের কারণে কমে আসছে পাখি আসার সংখ্যা। এ দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষায় রয়েছে আইন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইন যথাযথ কার্যকর করা গেলেই রক্ষা পাবে পরিযায়ী পাখিরা। পাশাপাশি দরকার সচেতনতাও।

বিশ্বে পরিবেশ বাদী সংস্থার মতে- পৃথিবীর ২০ ভাগ জায়গাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। জলাশয়গুলোর অবস্থা ঠিক রাখতে হবে। আর সব কিছু করতে হবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া কোন কিছুই সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

লেখক: বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ও গবেষণা সহকারী।