কেওক্রাডংয়ের পাদদেশে পরচ্ছিন্ন, শান্ত এক পাড়া। সবে অন্ধকার ঘনিয়েছে। পাড়া প্রধান ছোটখাট গড়নের অমায়িক এক মানুষ। মুখের বহু ভাজ, চোখের নিচের কুঁচকানো চামড়া জানান দিচ্ছে অনেকগুলো গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত পাড় করে এসেছেন। সেইসঙ্গে স্মৃতি হিসাবে জমা আছে হাজারো বিচিত্র ঘটনা।
একটা গল্প শুনতে চেয়েছিলাম। সত্যি গল্প। শুরু করলেন। মুখময় ছড়িয়ে পড়েছে হাসি। যেন সেই বয়সে ফিরে গেছেন, যে সময়টায় দিনে পাহাড়ি পথে আঠারো-কুড়ি মাইল হাঁটতে পারতেন অনায়াসে। রগটচা ভাল্লুকও তাঁকে দেখলে মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা করা যায় কিনা হিসাব-নিকাশে বশত।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতে লাগলেন। তবে কাহিনিটা এতো রোমাঞ্চকর ভাষার ছোট্ট সমস্যাটা উড়ে গেল এক নিমিষে। এমনই এক রাত ছিল। তবে সময়টা অন্তত পঁচিশটা বসন্ত আগের। ঘরের দোর আটকে দিয়েছিলেন। তারপরই ভয়ানক কাণ্ডটা হলো। তাঁর সবচেয়ে বড় গরুটাকে নিয়ে গেল ওটা। ডোরা বাঘ। যখন টের পেলেন তখন ওই রাতে কিছুই করার ছিল না আর।
আমি যেন হঠাৎ করেই পিছিয়ে গেলাম দুই যুগ কিংবা এরও আগে। স্পষ্ট একটা হুটোপুটির শব্দ শুনলাম। তারপর ভারি একটা কিছু হেঁচড়ে নেওয়ার আওয়াজ। বাঘ বড় সাইজের গরু বা মোষ মেরে নেয়ার সময় মাটিতে মড়ি ঘষটানোর কারণে যে শব্দ হয়!
বৃদ্ধের চেহারায় হঠাৎ যেন একটা ঝিলিক দেখলাম। তারপর আবার হাসলেন। বলতে শুরু করলেন পরদিন বন্দুক নিয়ে একাকী বাঘটা শিকারে বের হয়ে যাওয়ার সেই গল্প। প্রতিদিনই অন্তত একবার আফসোসটা হয় আমার। পৃথিবীতে অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশটা বছর আগে এলে কতো কিছু দেখতে পেতাম।
মধুপুর থেকে বাঘ-চিতা দুটিকেই বিদায় করে দিয়েছি আমরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল থেকে গণ্ডার নিশ্চিতভাবেই গিয়েছে। সিলেটের বনাঞ্চলকে বাঘ, বাইসন শুন্য করেছি অবলীলায়। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-পার্বত্য এলাকার বন-পাহাড়ে বিশাল দাঁতের হাতি একটাও আছে কিনা সংশয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই আবার মনে হয়, আচ্ছা এখন পৃথিবীতে থেকেও কি কিছু করতে পারছি? একের পর এক আঘাত আসছে বুনো প্রাণের ওপর। কক্সবাজারের পাহাড়ে হয় গুলিতে, না হয় বৈদ্যুতিক শকে খুন করা হচ্ছে একটার পর একটা বুনো হাতি। রেহাই পাচ্ছে না শিশু হাতিও।
বান্দরবান-রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে গভীর অরণ্যের বিশাল সব মহীরুহ মাটিতে আছড়ে পড়ছে একের পর এক। গহীন পাহাড়ও প্রকম্পিত করাতের কর্কশ শব্দে। ঝিরি থেকে তোলা হচ্ছে পাথর। ফলাফল, জল শুকিয়ে খা খা করছে এখন জলাধারগুলো। জঙ্গলে বাস যাদের সেই মায়া হরিণ, সাম্বারেরা একে একে মারা পড়ছে শিকারিদের গুলিতে, ফাঁদে। এদের মাংস খাবার কথা শুনলে জিবে জল চলে আসে কোনো কোনো পর্যটকের।
পাহাড়ে বিপন্ন চিতা বাঘ, ভাল্লুক, মেঘলা চিতাসহ কত বুনো প্রাণ। আবার পাহাড়ে-সমতলে ভুলক্রমে কোনো গ্রামের কাছে নিজেকে প্রকাশিত করে ফেলে প্রায়ই মেছো বিড়াল, চিতা বিড়াল, হগ ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক কিংবা সিভেট জাতীয় প্রাণী। তারা মারা পড়ছে নিজেদের সভ্য জীব দাবি করা আমাদের মানুষদের ক্রোধের আগুনে। কখনো আবার এই নীরিহ প্রাণীগুলোকে পিটিয়ে মারছে মানুষ নেহায়েতই পৈশাচিক আনন্দের খোঁজে।
তারপরও আজ যে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস। এ দিনে আশা হারাই কীভাবে? পার্বত্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বন-পাহাড়ে আবারো এক সঙ্গে রাজত্ব করবে বুনো হাতি-বাঘ-চিতা। মধুপুরে ফিরে আসবে চিতা বাঘ। সিলেটের অরণ্যে চিতা বাঘ-ঢোলের কবল থেকে নিজেদের এবং হরিণসহ অন্য নিরামিষভোজীদের বাঁচাতে গাছের মগ ডাল থেকে সতর্ক সংকেত দেবে প্রহরী হনুমান। বাঁশ ভাল্লুক, মেছো বিড়াল, সিভেট ও চিতা বিড়ালরা রাজত্ব করবে গ্রামীণ বনে। পাহাড়ে ধনেশদের ডাক শুনতে ধৈর্যের প্রহর গুণতে হবে না… এমনই সব আশা নিয়েই বাঁচতে চাই।
লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ।