পাওয়া গেল দুর্লভ মর্মর বিড়ালের মরদেহ!

মর্মর বিড়ালের মরদেহ। ছবি: শাতিল রহমান

প্রাণীবৈচিত্র্যে ঘেরা আমাদের এই বাংলাদেশে টিকে থাকা ১২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে কার্নিভোর/Carnivora বর্গের প্রাণীদের মধ্যে ফেলিডে/Felidae পরিবারে রয়েছে আটটি প্রজাতির বুনো বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা। দৈহিক গঠন, আকৃতি ও আকর্ষণীয় শরীরের রঙ এই প্রাণীদের করেছে অনন্য। মার্বেল বিড়াল এই প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। পুরো বিশ্বে এদের বিস্তৃতি হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল, ভারত, কম্বোডিয়া মায়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীবিদ্যার জনক প্রফেসর ড কাজী জাকের হোসেন কর্তৃক লিখিত  বাংলাদেশর বন্যপ্রাণীর উপর ১৯৭৪ সালে  প্রথম প্রকাশিত বই ’এন ইন্ট্রোডাকশন টু দ্যা ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ’র তথ্য অনুযায়ী- বাংলাদেশে মার্বেল বিড়ালের অবস্থান নিশ্চিতের কোন তথ্য-প্রমাণ নেই। তবে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে এটি আছে এবং পরবর্তী কয়েকটি বইয়েও একই তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

২০১৫ সালের আইইউসিএন বাংলাদেশ এর রেড তালিকার বইয়ে বাংলাদেশের বুনো পরিবেশে এই প্রাণীর দেখা যাওয়র রেকর্ড নেই। তবে সিলেট অঞ্চল থেকে একটি প্রাণীকে আবদ্ধ অবস্থায় পাওয়ার রেকর্ড পাওয়া যায়। যেটি কিনা সতীশ বাবু খাসিয়াদের থেকে ৪-৫ দিন বয়সি চোখ না ফোটা বাচ্চা হিসেবে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে রাখা হয়েছিল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। এ কারণে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্তের অভাবে এই প্রাণীটির ডাটা ডেফিসিয়েন্ট ক্যাটাগরীতে অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইন্সের ক্যামেরা ট্রাপিংয়ে ধরা পড়েছিল দুটি মার্বেল বিড়াল। প্রফেসর ড. মনিরুল এইচ খান রচিত ’ফটোগ্রাফিক গাইড টু ওয়াইল্ডলাইফ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী- এই প্রাণিটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বান্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মিশ্র চিরসবুজ বনের একটি বিরল প্রাণী।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের বায়েজিদ লিংক রোডে বেড়াতে যান শাতিল রহমান নামক এক তরুণ। দুপুরের পর রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অদ্ভুত একটি প্রাণী তার দৃষ্টিগোচর হয়। কাছে গিয়ে দেখেন এটি একটি বিড়াল জাতীয় প্রাণী মৃতদেহ। গাড়ির চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মাথা পুরোপুরি থেতলে গেছে। কৌতুহলী হয়ে ছবি তুলে শেয়ার করেন ডীপ ইকোলজি এন্ড স্নেইক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে। সেখানে বন্যপ্রাণী গবেষকরা এটিকে মার্বেল বিড়াল বলে চিহ্নিত করেন। এটির ইংরেজি নাম:মার্বে লড ক্যাট/Marbled Cat; বৈজ্ঞানিক নাম:Pardofelis mormorata। বাংলায় মার্বেল, বিড়াল ছোপাযুক্ত বিড়াল বা মর্মর বিড়াল বলা হয়।

মার্বেল বিড়াল বা মর্মর বিড়াল নিশাচর বৃক্ষবাসী প্রাণী। খাবারের সন্ধানে এরা পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসে। একাকী বসবাস করতে পছন্দ করে। আর পাখি, ইঁদুর জাতীয় প্রাণী শিকার করে। ধারণা করা হয়- সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এদের প্রজননকাল। আবাসস্থল নষ্ট ও বিচ্ছিন্ন হওয়া এই প্রাণীটির কমে যাওয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। চট্টগ্রাম শহরের আশেপাশের পাহাড়ি এলাকায় প্রাণিটির উপস্থিতি আশা জাগানিয়া হলেও ১৮টি পাহাড় কেটে তৈরি সংযোগকারী রাস্তা প্রাণিটিকে আরও বেশি হুমকির মুখে পতিত করেছে।

জাতীয় স্বার্থে উন্নয়ন, রাস্তা নির্মাণ জরুরি। কিন্তু এই রাস্তা তৈরি করার কারণে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের দিকেও নজর দেয়া জরুরি। বিভিন্ন দেশে এখন সড়ক নির্মাণের সময় বন্যপ্রাণীবান্ধব করিডোর তৈরি করা হচ্ছে। যা সড়ক দূর্ঘটনা থেকে বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস ও সংরক্ষণে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় বন্যপ্রাণীবান্ধব করিডোরের ব্যবস্থা নিশ্চত করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: বন্যপ্রাণী বিষয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।