বনায়নের কুফলে ২২ মাসে ৩৮ হাতির মৃত্যু?

মাত্র সাতদিনের মধ্যে একে একে পাঁচটি এশীয় বন্যহাতির মৃত্যু ঘটেছে বাংলাদেশে। সবশেষ আজ শনিবার ফাঁস হয়েছে চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলায় একটি বুনো হাতিকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়ার ঘটনা। একটানা হাতি মৃত্যুর ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলছেন প্রাণবিদেরা। উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সচেতন নাগরিকেরাও। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতিসহ বন্যপ্রাণীরা পাচ্ছে না বনায়নের সুফল।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করা বনবিভাগের সক্ষমতা ও আদৌ এই সংস্থাটি হাতি সংরক্ষণে আন্তরিক কিনা উঠছে এমন প্রশ্নও। তবে সংস্থাটি বলছে, জনবল ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার অভাবে চাইলেও সম্ভব হচ্ছে না হাতি বা বন্যপ্রাণী হত্যা মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা।

জানা গেছে, দুপুরে চকরিয়ায় হারবাং বিটের চুরাখলা মজিদ মুড়ার দক্ষিণ পশ্চিম পাশে ধান ক্ষেতে একটি এশিয়ান মৃত হাতির খোঁজ পায় বনবিভাগ। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‍“চকরিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে আমরা হাতির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেছি।”

এর আগে গতকাল শুক্রবার সকালে বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের পূর্ব চাম্বল এলাকার একটি ধান ক্ষেত থেকে হাতির মরদেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। গেল সাতদিনে চট্টগ্রামে তিনটি এবং শেরপুর জেলায় একটিসহ মোট পাঁচটি হাতির মৃত্যু হয়েছে।

চাম্বল ইউনিয়নে হাতি মৃত্যুর কারণ হিসেবে ময়নাতদন্তকারী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সমরঞ্জন বড়ুয়া বলেন, “হাতিটি অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যাওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। হাতির দেহে নিউমোনিয়া ছিল, এবং সেটির লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।” নিউমোনিয়া হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “হাতি কানে পানি ঢুকে নিউমোনিয়া হতে পারে। অথবা ঠান্ডা থেকেও হতে পারে।”

বাংলাদেশে আইইউনিএন’র হাতি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য প্রাণী চিকিৎসক নাসির উদ্দিন বলেন, ”ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয়ে হাতির নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে কানে পানি ঢুকে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ কম। কারণ যেকোন প্রাণীর কানের ভেতরে থাকা পর্দা ফুসফুসে পানি প্রবেশে বাধা দেয়।”

বনবিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ এই ছয় বছরে দেশে মোট ৬৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। তবে দেশের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত দুই বছরেই মারা গেছে ৩৮টি বুনো হাতি। এরমধ্যে ২০২০ সালে ২২টি ও ২০২১ সালের সাড়ে ১০ মাসে ১৬টি।

হাতি মারা যাওয়ার নেপথ্যে:

অধিকাংশ হাতিই খাবারের খোঁজে পাহাড় বা জঙ্গল থেকে লোকালয়ে এসে মানুষের হাতে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক সময় পাহাড় বা বনাঞ্চলে হাতির জন্য পর্যাপ্ত খাবারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ছিল। কিন্তু দিন বদলের সঙ্গে মানুষ হাতির বিচরণক্ষেত্রে লোকালয় ও আবাদের জমি গড়ে তুলেছে। ফলে দিন দিন হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমতে শুরু করেছে।

কিন্তু সরকার বনবিভাগের মাধ্যমে বনায়নের যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে মূলত সেগুলো কাঠ উৎপাদন এবং এ থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যে করা হয়েছে। ফলে বন্যপ্রাণীর খাওয়ার উপযোগী ফলজ ও বনজ গাছের বনায়ন এবং ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। এতে হাতির মতো প্রাণীরা বনের পরিবেশে খাবার না পেয়ে লোকালয়ের আবাদি জমিতে আসতে শুরু করেছে। এতে বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘর্ষ।

বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের ইমারজেন্সি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের সদস্য আবদুস সাত্তার বলেন, “গতকাল মারা যাওয়া হাতিটি গেল বৃহস্পতিবার সকালেও পাশের একটি পেয়ারা বাগানে এসেছিলো। ওই সময় স্থানীয়রা হাতিটিকে ঢিল ছুঁড়ে, শব্দ করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো।”

“যে ছোটবিলে হাতির মরদেহ ছিল সেটি মূলত হাতি চলাচলের রাস্তা। মূলত চুনতি অভয়ারণ্যে থেকে হাজারীখোলা, রামদাশ হাট হয়ে বড় বিল, ছোটবিল ও হরিন্যাঘোনা এলাকায় নিয়মিত চলাচল করে। সাধারণত এরা মানুষের ক্ষতি করে না,” উল্লেখ করেন আবদুস সাত্তার।

স্থানীয় কৃষক চাঁনমিয়া বলেন, “বছর তিনবছর ধরে কিছুদিন পরপরই হাতি ফসলের ক্ষেতে আসছে। তবে আগে কখনো হাতি জমিতে আসতো না। যখন থেকে পাহাড়ে হাতির খাবারের সংকট শুরু হয়েছে তখন থেকেই লোকালয়ে এসে ধানক্ষেত্র, বাগান ও বাড়িঘরের গাছপালা খেয়ে যাচ্ছে।” পাশাপাশি আগের তুলনায় হাতি এখন লোকলয়ে বেশিই আসছে বলেও জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য:

প্রাণিবিদ মনিরুল হাসান খান বলেন, ”একের পর এক যেভাবে হাতি হত্যা করা হচ্ছে, তা চলতে থাকলে প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এখন লোকালয় বলতে যা বোঝায় তা একসময় ছিল হাতির বিচরণক্ষেত্র। মানুষ হাতির জায়গা দখল করেছে। তাহলে হাতি যাবে কোথায়? ফলে এসব জায়গায়ই হাতির সঙ্গে মানুষে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। বন্যপ্রাণী রক্ষায় আইন আছে। কিন্তু এসব আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে যারা বন্যপ্রাণী হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে।”

আইইউসিএন’র হাতি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, ঐতিহাসিক কাল থেকে হাতি হত্যা ও হাতি কর্তৃক মানুষ হত্যা হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। এভাবে প্রাণীটি মারা যাওয়ার সঠিক কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্বের যে স্থানগুলো আছে সে জায়গায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। হাতি চলাচল থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণীর জন্য সঠিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে।

বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী সার্কেল) মোল্লা রেজাউল করিম বলেন, ”হাতি চলাচলের পথ দখল করে সেখানে বাড়িঘর করছে মানুষ। সরকারও বিভিন্ন জায়গায় ভূমি নিয়ন্ত্রণ করে ইজারা দিচ্ছে। আমরা হাজার হাজার মামলা করেছি। কিন্তু সেসব মামলা এখন ঝুলে আছে। মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না।”

বাংলাদেশ বন বিভাগ ও প্রকৃতি-প্রাণী সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএনের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দেশে এশিয়ান বন্য হাতি ছিল ২৬৮টি। আর সরকারি অনুমতিক্রমে দেশে পালিত হাতি ছিল ১০০টি। কিন্তু দিন দিন মৃত্যুর ঘটনা বাড়ায় এই সংখ্যা এখন কমেছে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।