বুনো হাতির মৃত্যু ঘণ্টা

বাংলাদেশের শেরপুর জেলার বালিঝুড়ি এলাকায় এশিয়ান বন্যহাতির দল। সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন প্রাণীবিদ মনিরুল হাসান খান।

আমার জানা মতে বুনো এশিয়ান হাতি আছে এখন পৃথিবীর কেবল তেরোটি দেশে। এটা ভেবে সব সময় গর্ব হতো এই দেশগুলোর একটি আমাদের বাংলাদেশ। তবে গত কিছুদিন ধরে একটা আশঙ্কা দানা বাধছে মনে। এই গৌরবময় তালিকা থেকে আবার বাদ পড়তে হবে না তো আমাদের? আজ (৬ নভেম্বর) সকালের একটি ঘটনায় আবারও কু ডাকছে মনে।

ঘটনাস্থল চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের এক ধানক্ষেত। আজ ভোরে ওই ধানি জমিতেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এক মাদি হাতিকে। বেচারি রাতের কোনো এক সময় ধান খেতে এসেছিল সেখানে। এটাই তার কাল হয়েছে। ধান ক্ষেতে পেতে রাখা বিদ্যুতের ফাঁদে মৃত্যু হয়েছে বিশালদেহী জন্তুটার। যদ্দুর জানা যায়, ধান রক্ষা করতে এই ফাঁদ পেতেছিল কৃষকেরা। বন বিভাগের রেঞ্জার, স্থানীয় ইউপি সদস্য আর এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য অন্তত তাই বলছে।

গত দেড়-দুই বছর ধরে একের পর এক হাতি মারা যাওয়ার খবর পাচ্ছি আমাদের অরণ্যগুলো থেকে। কক্সবাজার-টেকনাফ-লামা-আলীকদমসহ চট্টগ্রামের পাহাড়ে বেশ কয়েকটি বড় পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতিদের, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। রোহিঙ্গা বসতির কারণে ওগুলোর কয়েকটি এক রকম বন্দীজীবন কাটাচ্ছে। আছে চরম খাবার সংকটে। আর হাতি মৃত্যুর যে ঘটনা ঘটছে, তার প্রায় সবগুলোই কক্সবাজার-লামার বন-পাহাড়ে। এর মধ্যে অনেকগুলো মারা পড়েছে কীভাবে শুনবেন? বিদ্যুতায়িত তারের স্পর্শে। বেশ কিছুকে হত্যা করা হয়েছে গুলি করে। আমরা মানুষেরা পরিকল্পিতভাবে এটা করেছি। আজকের এই ঘটনাও এগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়।

এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ১২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে হাতির বিচরণ আছে—এমন তিনটি সংরক্ষিত অরণ্য চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের ২৭ কিলোমিটার বনাঞ্চল কেটে যাবে রেললাইনটি। যত দূর জানি, ওই রেলপথ যাবে হাতি চলাচলের অন্তত ছয়টি করিডরের ওপর দিয়ে।

এখন হাতি মারা হচ্ছে গুলি করে, বিদ্যুতায়িত করে; রেললাইন তৈরি হলে রেলগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে আরও কিছু মারা পড়া খুব স্বাভাবিক। কারণ, ওই হাতিগুলোর রেলগাড়ি নামক যন্ত্রদানবের সঙ্গে পরিচয়ই নেই। কাজেই ওই পথে ‌রেলগাড়ি চলাচল শুরুর আগেই প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

কক্সবাজার-লামা বাদে তাহলে হাতিরা ভালো আছে? একেবারেই না, ওই সব অরণ্যে হাতির অবস্থা আগে থেকেই ভয়াবহ। আমার জানামতে, সিলেট বিভাগে লাঠিটিলা বাদে আর কোথাও এখন এমনকি সীমান্ত পেরিয়েও আসে না হাতিরা। এই বুনো জন্তুরাও বুঝে গেছে, সীমানা পেরোলেই বিপদ! ওই হিসাবে জামালপুর-শেরপুরের দিকটায় গারো পাহাড়ের ভারতের অংশ থেকে নামা হাতিগুলো নিরেট গর্দভ! বছরে কয়েক মাস আমাদের সীমানায় কাটায় এরা। তবে যেগুলো আসে, সবগুলো ফিরতে পারে না। বিদ্যুতায়িত করে এই এলাকায়ও হাতি মারা হয় নিয়মিতই।

আইইউসিএনের ২০১৬ সালের জরিপে এ দেশে স্থায়ী বুনো হাতির মোট সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৬৮টি। যেভাবে বুনো হাতি হত্যা হচ্ছে, সংখ্যাটা কতটা কমেছে খোদা জানে!

লেখক: সাংবাদিক, বাংলাদেশ।