তিনটি এশিয়ান বুনো হাতিকে তাড়িয়ে দিতে চায় বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান কেইপিজেড। এজন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে ২২টি চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। বনবিভাগ বলছে, বাংলাদেশে আবাসস্থল থেকে বন্যপ্রাণীদের সরিয়ে নেয়ার নিয়ম নেই। তবে তা মানতে নারাজ সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, প্রয়োজনে আইন সংশোধন বা প্রণয়ন করে হলেও সরিয়ে নিতে হবে বুনো হাতিগুলোকে।
গেল ২০ অক্টোবর কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. শাহজাহান সাক্ষরিত চিঠিটি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। এই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং কর্ণফুলি ও আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও। চিঠিতে বলা হয়, কেইপিজেড বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মস্থল। কিন্তু গত তিন বছর যাবত বন্যহাতির একটি পাল ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে।
আরো বলা হয়, গত দুই-তিন মাস ধরে তিনটি হাতি ইপিজেড এলাকায় প্রবেশ করে গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতি করছে। গত তিন বছরে হাতির আক্রমণে কেইপিজেড ও আশপাশের এলাকার ১০ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার ক্ষতি করেছে বন্যহাতির একটি পাল। বর্তমানে প্রতি রাতেই হাতিগুলো কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে। তাই যদি এখনই এই হাতিগুলোকে কেইপিজেড এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া না হয়, তবে ক্ষতি মুখে পড়বে আন্তর্জাতিকমানের এই রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলটি।
জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী তীরের পাহাড়ঘেরা আনোয়ারা উপজেলায় রয়েছে ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড়। অদূরেই রয়েছে বাঁশখালী ইকো পার্ক, চুনতি ও দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী, লোহাগাড়াসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি পথের অন্যতম অবস্থানে আনোয়ারা। তবে ১৯৯৯ সালে দেয়াঙ পাহাড়ের পাশেই রপ্তানী প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল করতে কোরিয়ান ইয়ং ইয়ং কোম্পানীকে আড়াই হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। এরপর দুই দশকে অবকাঠামো নির্মাণ, বনায়নসহ পরিবেশগত উন্নয়ন সাধন করে কোরিয়ান ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এতে এই নিরাপদ ভেবে আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখিসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যহাতিও।
কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “আমরা বন্যপ্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল। এজন্য কেইপিজেড এলাকায় প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বনায়ন করা নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বুনো শিয়ালসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। কিন্তু বন্যহাতি আমাদের জন্য আতঙ্কের। এ অবস্থায় কেইপিজেডের ভেতরে কোন শ্রমিক যদি হাতি দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে এটি আমাদের উৎপাদন কার্যক্রমের জন্য ক্ষতিকর হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা বনবিভাগসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে হাতিগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছি। বাংলাদেশে চিড়িয়াখানা আছে, সাফারি পার্ক আছে অথবা বান্দরবান অঞ্চলে যে রিজার্ভ ফরেস্ট আছে প্রয়োজনে সেখানে সরিয়ে নেয়া যেতে পারে,” উল্লেখ করেন মো. শাহজাহান।
বন্যপ্রাণী স্থানান্তরিত করার ক্ষেত্রে এ দেশের প্রচলিত আইন ও সংরক্ষণ নীতিমালার বাধ্যবাধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আইন মানুষের জন্য, মানুষকে সুরক্ষা দিতে প্রয়োজনে যদি আইন সংশোধন করতে হয়- তবে তাও করা যেতে পারে। আমরা আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তাই কোন অবস্থাতেই এই হাতিগুলোকে এখানে রাখা সম্ভব হবে না।”
কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আমরা এই হাতিগুলোকে সরাতে নানা তৎপরতা নিয়েছি। তাই আমরা বন্যপ্রাণী ও হাতি বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি, তারা সরেজমিনে দেখেছেন। তারাও বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন। মূলত আমরা বন্যপ্রাণী বা হাতিদের কোন ক্ষতি হোক তা চাই না।”
বনবিভাগ ও কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের বৈঠক:
গতকাল ১৪ নভেম্বর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান মোল্লা রেজাউল করিম ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী কেইপিজেড পরিদর্শনে যান। এ সময় তারা কেইপিজেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহানের সঙ্গে ঘন্টাব্যাপী বন্যহাতি প্রসঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় কেইপিজেট কর্তৃপক্ষ নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি ও শঙ্কাগুলো তুলে ধরেন।
বৈঠকে বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি কক্সবাজার অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের কারণে হাতির কোরিডোর নষ্ট হওয়াতে নিরাপদ ভেবে এবং খাবার থাকায় আবার আসতে শুরু করেছে আনোয়ারায়। প্রকৃতিগতভাবেই হাতিগুলো সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে কেইপিজেডকে সাফ জানিয়ে দেন মোল্লা রেজাউল করিম। তিনি বলেন, “এ হাতিগুলো হঠাৎই এখানে আসেনি। এটি তাদের অনেক আগের আবাসস্থল। মাঝে হয়তো কোনো কারণে হাতিগুলো এখানে ছিলো না, এর মানে এই নয় যে হাতিগুলো আনোয়ারায় থাকতে পারবে না।”
বন কর্মকর্তারা যা বললেন:
বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “কর্তৃপক্ষ চাইলে কেইপিজেড এলাকার ভেতরেই হাতিগুলোকে সুরক্ষিতভাবে রাখা যেতে পারে। এজন্য তারা বিকল্প রাস্তার সৃষ্টি করতে পারে এবং বনবিভাগ, কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ ও গ্রামবাসীর মাধ্যমে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন করে দেয়া যেতে পারে। এতে তারা হাতির চলাচল পর্যবেক্ষণ করে স্থানীয়দের ও কেইপিজেডের শ্রমিকদের হাতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। এই পদ্ধতিতে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি হাতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যাবে।”
”কোনো কারণে যদি জোর করে হাতিগুলোকে এই অভয়ারণ্য থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা হিতে-বিপরীত হতে পারে। এর আগে অনেকবার মানুষের এমন চেষ্টার পর মানুষের বাড়ি-ঘরে হাতির হামলার ঘটনা ঘটেছে,” উল্লেখ করেন মোল্লা রেজাউল করিম।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া। আবার কক্সবাজারের উখিয়া, চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কর্ণফুলী। এই দু’টি পথ এশিয়ান বুনো হাতির চলোচলের হাজার বছর পুরোন পথ।”
স্থানীয়রা যা বললেন:
আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দারা জানান, কেইপিজেডের ভেতরেই ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড়ের একটা অংশ রয়েছে। আশপাশের বিভিন্ন এলাকার পাহাড়ি পথ দিয়ে দেয়াঙ পাহাড়ের এই হাতির চলাচল অনেক আগ থেকেই। স্থানীয় মানুষেরা হাতির ক্ষতি চায় না। হাতি এলে জমির ধান ও বসতবাড়িতে থাকা কলাগাছ খেয়ে ফিরে যায় পাহাড়ে। কেউ হাতির মুখোমুখি হলে তখনই আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এতে নিহত ও আহতরা ক্ষতিপূরণ পাননি। তাই হাতি এখন তাদের জীবন-জীবিকার জন্য ক্ষতিকর প্রাণী। ক্ষতি কমাতে ১২ জনের একটি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমও গঠন করে দিয়েছে বন অধিদপ্তর। কিন্তু এ দলের কয়েকজন বাদে বাকিরা দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ করেছেন বড়উঠান গ্রামের বাসিন্দারা। তবে গ্রামের কেউই হাতির ক্ষতি চান না বলে জানান।
হাতির আক্রমণে পা ও পাঁজরে গুরুতর আহত কর্ণফুলী ইউনিয়নের বড়উঠান খিলপাড়া বায়তুল ফালাহ্ জামে মসজিদের খতিব মাওলানা এয়ার মোহাম্মদ আনোয়ারী বেঙ্গল ডিসকাভার-কে বলেন, “ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য যাওয়ার পথে আমি হাতির সামনে পড়ে যাই। এ সময় হাতি আমাকে শুঁড় দিয়ে ধাক্কা দেয়। আসলে হাতির কোন দোষ নেই। সেও তো আল্লাহর সৃষ্টি। আমি তার রাস্তায় পড়াতেই ভয় পেয়ে ধাক্কা দিয়েছিল। ওরা তো অবলা প্রাণী। বুঝলে তো আর আমার ক্ষতি করতো না।”
হাতি বিশেষজ্ঞরা যা বললেন:
আইইউসিএন’র হাতি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, “কর্ণফুলী ইপিজেড এলাকায় হাতির চলচল নতুন কিছু নয়। প্রতিবছর শীতের সময় খাবারের খোঁজে পাহির পাল এ এলাকায় আসে। ঐতিহ্যগত ভাবে এটি হাতি চলাচলের রাস্তা। এখান থেকে হাতিদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
“তবে হাতি থেকে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও ইপিজেডকে সুরক্ষার জন্য এর চারপাশে ‘সোলার ইলেকট্রিক ফেন্সিং’ করা যেতে পারে। এতে হাতিও মারা যাবে না, ইপিজেড কর্তৃপক্ষও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়া স্থানীয় গ্রামগুলোর সুরক্ষার জন্য “অর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ চালু করা যেতে পারে, এতে হাতি আসার আগেই খবরটি গ্রামবাসী জেনে যাবে,” উল্লেখ করেন নাসির উদ্দিন।