জঙলা আর বাঁশ ঝোপ পাখিদের নিরাপদ আস্তানা। ঘরের সামনের ঝোপঝাড়ে হরেক রকম পাখিদের আনাগোনা। প্রতিদিন সকাল ভোরে একটা মাছরাঙা সুরেলা ডাকে ঘুরে বেড়ায় জঙলার ধারে কাছেই। আমার বাচ্চাকে তখন বলি দেখ মাছরাঙাটা তোমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকছে, বলছে, ওঠো, স্কুলে যাও। আমার বাচ্চাটা তখন নার্সারিতে থেকে কেজি ক্লাসে উঠেছে। গেল দু’বছর ধরে মাছরাঙাটি পালন করছে এই দায়িত্ব। আর আমার বাচ্চাও বিষয়টি বিশ্বাস করেছে। সে জানতে চায় সে যে স্কুলে পড়ে তা মাছরাঙা কীভাবে জানে?
ভোরে আলো ফোটার আগে ঘর লাগোয়া কড়ই গাছ বা কখনো কৃষ্ণচুড়ার গাছ থেকে মধুর সুরে দোয়েলের শীষ শুনি। তারপর কাকেদের শোরগোল। বড়ই ঝামেলা বাজ পক্ষি। দোয়েলের সুরের পর যা সত্যিই বিরক্তিকর। এতদিন আবাসিক এলাকায় থেকে আমার বাচ্চা একটি পাখি ভালোভাবেই চিনেছিল, তা হলো কাক। কদাচিৎ ভাত শালিক দেখা যেতো।
বাসার সঙ্গে কটি নারিকেল গাছ ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা কেবলই কাকের কা কা স্বর। একদিন সন্ধ্যায় নারিকেল গাছে একটা পেঁচা এসে বসেছে। এই পাখিটা অদ্ভুত ঠেকেছে বাচ্চার কাছে। আসলেই এক অদ্ভুত পাখি এই পেঁচা। দিনের আলোয় তার কোন দেখা নেই। আর সন্ধ্যা হলেই বের হয় খাদ্য সংগ্রহে।
আমাদের ছোটবেলায় পেঁচাকে দেখলে তার চোখে চোখ রেখে দেখে থাকলে পেঁচা তার মাথাটা একবার নিচু আবার উঁচুতে তুলে আমাদের দেখতো। তারপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উড়ে যেতো। রাতে বাসায় ফিরে আসার পর ছেলে শুরু করে নতুন দেখার পাখির বয়ান। কোনভাবেই বুঝাতে পারছিলো না। পরে তার দাদু এসে বিষয়টি খোলসা করে। এই প্রথম সে পেঁচা নামক একটি পাখির নাম শুনলো এবং পরিচিত হলো।
আবাসিকের বাসা ছেড়ে এই বাসায় যখন আসি সময়টা ছিলো শীতের শেষ। সামনের খোলা জায়গাটা নানানরকম জঙলি লতা ও গাছে ভরা। কিছু কিছু লতার ফুলে বর্ণিল প্রজাপতির উড়াউড়ি। আর এ ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে ছোট জাতের বুলবুলি পাখির দল। বাসাটায় একচিলতে একটি ব্যালকনি আছে। বসে আছি ছেলেকে নিয়ে। নতুন জায়গা। তাই বাহিরে কম যাই।
বাবা ফুলের উপর ওগুলো কী পাখি? জানালাম ওগুলোকে প্রজাপতি বলে। ওগুলো কী পাখি? ওর মা বললো এরা হচ্ছে বুলবুলি পাখি। পাখিগুলোর লেজের নিচে লাল কেন? জানতে চাইলো ছেলে। কী বলবো, বুঝতে পারছিলাম না। পরে বললাম এটা সৃষ্টিকর্তা বানিয়েছেন তো, তুমি বড় হলে বুঝতে পারবে। বিকেলের রোদ আরো একটু নেমে এসেছে। পাঁচ তলা দালানটার ছায়া আরো দীর্ঘ হচ্ছে।
কিছু বক দূর থেকে উড়ে এসে বাঁশ ঝোপের উপর বসতে শুরু করে। খোলা জঙলায় পত্র-পল্লবহীন কিছু গাছ ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদল কাক নিজেদের মতো করে গাছে বসছে, উড়ছে আবার বসছে। দুই তিনটে ফিঙে আমরা বলি ধেউচ্ছা। খুবই বুদ্ধিমান পাখি বলে পরিচিত। হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে ডালে বসে থাকা কাকেদের উপর দিয়ে ফাইটার বিমানের মতো ডিগবাজি দিতেই কাকগুলো উড়ে পালিয়েছে।
ফিঙের এমন কাজ দেখে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, বাবা ফিয়ে (তখনও ফিঙে বলতে পারছিলনা) পাখিগুলো এমন করলো কেন? কী বলবো ভাবছি। পরে বললাম ওরা একটু মজা করেছে আরকি। ছেলের প্রশ্ন- এগুলো কী দুষ্টু পাখি?
সূর্যটা সেদিনের মতো ডুবে গেছে। একটু অন্ধকার। শহরেতো আঁধারের রঙ বুঝা যায়না বৈদ্যুতিক বাতির কারণে। গ্রামে এক সময় জোছনা ও আঁধারের রঙ আমরা বুঝেছিলাম। এখন গ্রামে বিদ্যুৎ বাতি জ্বলে। গা ছম ছম গাঢ় অন্ধকার এখন আর পাওয়া যায় না। অন্ধকারে দুটো পেঁচা এসে বসেছে মরা গাছের ডালে। আমাদের দিকে মুখ করে। বসেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ডেকে উঠলো। এভাবেই প্রতিদিন বাবা ছেলের পাখি দেখা চলছে। মাঝে মধ্যে ছেলের মাও যুক্ত হয়। ব্যালকনিতে বসেই বিকেলের চা পান করি কখনও কখনও। বেশ ভালো লাগে।
বিকালে দূরের বিল্ডিং বা দালানগুলোর ছাদে ছেলে মেয়েরা উঠে হাটাহাটি করতে দেখা যায়। কেউ ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড় নিতে এসে কিছুক্ষণ থাকে। আমাদের বাসার ছাদে উঠার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। ছাদে বড় একটি টিনের দরোজা সব সময় তালা দেওয়া থাকে। বর্ষায় জঙলা মাঠে পানি জমে। ভালোই জমে। জমানো পানিতে মরে যাওয়া বুনো কচু গাছ গুলো হলহলিয়ে বেড়ে উঠে। মাঠের ধারে ডোবা থেকে মাছেরাও উঠে আসে নতুন জমানো পানিতে। তখন বক বসে মাছের আসায়। জোড়া জোড়া ডাহুক ঘুরে বেড়ায়। কিছু দিন পর মা ডাহুক কালো কালো ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে আসে এখানে। হয়তো বলে আমি তোমাদের বাবাকে নিয়ে এখানে কত ঘুরেছি।
একদিন সকালের পর এক ডাহুকী মা কালোমতো চারটি বাচ্চা নিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। ছেলেটাকে ডাকলাম। বাচ্চাগুলো দেখতে মুরগির ছোট্ট বাচ্চার মতো। মা’র পিছনে চিক চিক করে ডেকে ডেকে হাঁটছে। ডাহুকীর বাচ্চা দেখিয়ে পরলাম ফ্যাসাদে। ছেলেটা বায়না ধরেছে বাবা আমাকে দুটা ডাহুকের বাচ্চা এনে দাও না। বললাম পাখির বাচ্ছা ধরতে নেই। ওদের মা কান্না করবে। বাচ্চারাও কান্না করবে, মরে যাবে।
বালক বেলায় ঘুঘু বাচ্চা ধরে পুষে ছিলাম। গুলতি কত পাখি শিকার করেছি। একবার এক সকালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে নানার বাড়িতে গড়ের ধারে বলাই গাছে ঢিল ছুঁড়ে এক মা ডাহুক আহত করে ধরে ফেলেছিলাম। তারপর দুপুর বিকেলে সঙ্গী পাখিটা কেবল কোয়াক কোয়াক করে সেই গাছের উপর উড়ছিলো। পাখিটার আর্তচিৎকারে কাছে গিয়ে দেখলাম বাসায় চারটা ফুটফুটে ডিম পরে আছে। তারপর থেকে আর কখনও পাখি শিকার করিনি। এসব তো আর ছেলেটাকে বলা যাবে না।
ছেলে দৌড়ে গিয়ে তার মা’কে নিয়ে আসলো ডাহুকের বাচ্চা দেখাতে। মা ও ছেলে ফিরে আসার আগেই ওরা ডাহুক ছানাদের নিয়ে ছোট একটা ঝোপের ভিতর ঢুকে পরে। বললাম একটু অপেক্ষা করো আবার বের হলে দেখতে পারবে। ছেলের মা ডাহুক দেখেছে, ডাহুকের বাচ্চা দেখেনি কখনও, জানালো সেটা।