
জনপরিচিত পাখি কাক। অন্য পাখির মতো রঙিন না হলেও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্ব বহন করে কাক। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দেখা যায় কাক। পরিবেশের অবাঞ্চিত বস্তু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে কাক। ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে পরিবেশকে রক্ষা করে কাক। অবাঞ্চিত বস্তু দিয়ে ঘর তৈরি করে থাকে কাক। এসব কারণে প্রাকৃতিক ঝাঁড়ুদার পাখি বলা হয় কাককে। কাক প্রজাতির পাখির একটি হচ্ছে- পাতিকাক। এটির বৈজ্ঞানিক নাম- করভাস স্পেলেনডেন্স/Corvus splendens, ইংরেজিতে- হাউজ ক্রো/House Crow বলা হয়।
পাতিকাগ বা পাতিকাউয়া কর্ভিডি/Corvidae) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত পরিচিত পাখি। মানুষ যেসব জায়গায় প্রথম বসতি স্থাপন করে, যেমন- চরাঞ্চলে, সেসব জায়গায় পাতিকাকও মানুষের সাথে সাথে বসতি করে। কারণ এরা সর্বভূক আর যেকোন প্রকারে বাসা বানিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম।
মানুষের উচ্ছিষ্ট খেয়েই এরা জীবনধারণ করতে পারে। আর যে এলাকা যতো বেশি নোংরা, সেই এলাকায় ততো বেশি পাতিকাক দেখা যায়। সেকারণে শহরাঞ্চলে পাতিকাক দেখা যায় উল্লেখযোগ্য পরিমানে। তবে বর্তমানে শহুরে এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ কমতে থাকায় পাতিকাক দেখা যায় না তেমন।
পাতিকাকের দ্বিপদ নাম- করভাস স্পেলেনডেন্স, নামকরণ করা হয় ১৮১৭ সালে। এ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়েছে পাতিকাকের চারটি উপপ্রজাতি। পাতিকাকের মাথার পেছন থেকে গলা ও বুক এবং পেটের সামনের দিকটা ধূসর বা ফ্যাকাসে ধূসর; বাকি সারা দেহ, ঠোঁট, চোখ এবং পা কালো। মাথার তালু, কপাল ও গলার নিচের দিকটাও কালো। ঠোঁট দাঁড়কাকের মত, তবে একটু কম বাঁকা। ঠোঁটে গোঁফ দেখা যায়। দৈর্ঘ্য ৪২ থেকে ৪৪ সেন্টিমিটার। প্রতিটি ডানার দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৭.৫ সেন্টিমিটার। ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম।
পাতিকাকের অজানা তথ্য:
পাতিকাকের গোসল করার প্রবণতা প্রবল। জমাট বাঁধা পানিতে বা পানির ধারায় একাকী বা দলবদ্ধভাবে পানি ছিটিয়ে গোসল করে। কখনও কখনও বৃষ্টির সময় কাকেরা জুবুথুবু হয়ে এক জায়গায় বসে বৃষ্টিতে ভেজে। কাকেদের বৃষ্টিভেজা অবয়বের ধারণা থেকেই কাকভেজা বাগধারাটির উৎপত্তি।
পাতিকাকের ডাক কর্কশ কা-কা-কা। বিপদের আশঙ্কা দেখলে এরা একসাথে দলবদ্ধ হয়ে সতর্ক-সূচক কা কা ডাকে। মজার ব্যাপার হলো- গলা কর্কশ হলেও কাক আসলে গায়ক পাখি, কিন্তু কোকিল গায়ক পাখি নয়। কারণ কাকের গলায় স্বরথলি বা ভয়েস বক্স আছে, কিন্তু কোকিলের নেই।
প্রায়ই বৈদ্যুতিক তারে বেঁধে পাতিকাক মারা যায়। রাণীক্ষেত, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে, কলেরা, বটুলিজম ও বসন্তে আক্রান্ত হয়ে কিছু কাক মারা যায়। পাতিকাক এসব রোগ ছড়াতেও ভূমিকা রাখে। বার্ড ফ্লু রোগের প্রকোপ বেড়ে গেলে জালালি কবুতরের পাশাপাশি পাতিকাকের দিকেও নজর রাখতে হয়। মানুষের নিউক্যাসল রোগ ছড়াতেও পাতিকাক ভূমিকা রাখে।
খাদ্যাভ্যাস
পাতিকাক সর্বভূক, অর্থাৎ সব খায়। এদের খাদ্যতালিকা বেশ বড়। প্রাণীর মল থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, হাঁসমুরগীর ছানা, পোকামাকড়, ফলমূল, বড় বড় ফুলের মধু, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, ছোট সরীসৃপ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়। পাতিকাক শিকারি পাখির উচ্ছিষ্ট খাবার জন্য ওঁত পেতে থাকে। অনেক সময় শিকারি পাখিকে দলবদ্ধভাবে ধাওয়া করে তার শিকার ছিনিয়ে নেয়।
প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি
পাতিকাকের প্রজনন ঋতু মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত, তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর বিভিন্নতা দেখা যায়। পাতিকাক কোকিল, চোখগেলো, পাপিয়াসহ অন্যান্য বাসা পরজীবী পাখির পোষকের ভূমিকা পালন করে। এসব পাখি পাতিকাকের বাসায় ডিম পেড়ে যায়, পাতিকাক সেই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায় আর লালনপালন করে। পাতিকাক একবারে ৩-৬ টি ডিম দেয়। ডিমের রঙ সবজে-আকাশী, তার উপর কালচে-বাদামী ফোঁটা।
স্ত্রী কাকই মূলত ডিমে তা দেয়। পুরুষ কাকও দেয়, তবে খুব কম সময়ের জন্য। তবে বৃষ্টি নামলে. শিলাবৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড রোদ পড়লে পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সাথে ডিম আগলে বসে। ১৬ থেকে ১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সদ্যোজাত ছানার গায়ে পালক থাকে না, চোখ বন্ধ থাকে। দেহের বর্ণ আর ঠোঁট গোলাপী থাকে। ৭-১০ দিন বয়েসী ছানার শরীর কালচে হয়,ঠোঁট কালচে-ধূসর। চোখ কালো। ২১ থেকে ২৮ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে।
বাসা তৈরি
প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাটা টিনের টুকরো, কাপড়ের টুকরো, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন, কাঠিকুঠি, সাইকেল ও রিকশার স্পোক, ফেলে দেয়া কাগজ অর্থাৎ একটি জনপদের পরিত্যাক্ত প্রায় সবকিছু দিয়েই পাতিকাক আগোছালো বাসা করে। ঘরের ছোটখাটো জিনিস চুরি করেও এরা বাসা বানায় বা সাজায়। অসম্ভব জায়গায় বাসা করার প্রবল প্রবণতা রয়েছে কাকের। যেখানে বাসা করা সম্ভব নয় এমন জায়গায় খড়কুটো এনে জড়ো করে। খড়কুটো পড়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলেও বারবার সেখানেই খড়কুটো নিয়ে আসে।
সাধারণত লোকালয়ে গাছের ডালে, বৈদ্যুতিক খুঁটি, জানালার আলিশায় বা বসতবাড়ির কোণায় এরা বাসা করে। কলোনি করে বাসা করে না, তবে যেসব অঞ্চলে পাতিকাকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি, সেসব অঞ্চলে এক জায়গায় অনেকগুলো বাসা দেখা যায়। মূলত স্ত্রী কাকই বাসা করে, পুরুষ কাক একটু সহযোগিতা করে মাত্র। বাসায় ডিম থাকলে পাতিকাকের আচরণ আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এসময় বাসার আশেপাশে মানুষ, কুকুর, বিড়াল বা অন্য প্রাণী বা পাখি এলে এরা ঠোকর দেয় বা তাড়া করে।
বিচরণ
বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, চীন, হংকং, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আফগানিস্তান, কাতার পাতিকাকের প্রধান আবাসস্থল। এছাড়া বার্বাডোস, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, মিশর, জিব্রাল্টার, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইসরাইল, জর্ডান, কেনিয়া, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, নেদারল্যান্ডস, ওমান, সিশেলেস, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুদান, তাঞ্জানিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়েমেন ও যুক্তরাষ্ট্রে পাতিকাক অবমুক্ত করা হয়েছে।
কখনো কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, জাপান, স্পেন ও যুক্তরাজ্যেও এদের দেখা যায়। ধারণা করা হয়- সম্ভবত পার্শ্ববর্তী কোন দেশ থেকে চলে আসে। চিলিতে পাতিকাক দেখা গেছে, তবে এদের উৎস নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজের মাধ্যমে পাতিকাক পৌঁছেছিল ও বংশবিস্তার করেছিল, কিন্তু সেখানে এদের প্রায় নির্মূল করা হয়েছে।
কাক পরিচিতি
কাক মূলত ক্রো প্রেসারিফর্মস/Crow Passeriformes বর্গের কোরিডেয়/Corvidae গোত্রের তুলনামূলকভাবে বড় আকারের পরিচিত পাখি। চকচকে কালো রঙের দেহ এবং অধিকাংশেরই শক্তিশালী কালো ঠোঁটের গোড়া পালকে ঢাকা। কাক সর্বভুক পাখি। প্রকৃত কাকেরা করভাস/Corvus গণভুক্ত, যারা সাধারণত কালো রঙের এবং বিশ্বের সর্বত্র বিস্তৃত। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও চতুর পাখি হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভাঁড়। এরা যূথচর, মাঝে মধ্যে খুব বড় দলেও থাকে, কিন্তু একত্রে ঘুমায় না।
প্রত্যেক জোড়ার পৃথক বাসা থাকে। বাসা খুব সাধারণ, ডালপালার একটি মাচান। স্ত্রী ও পুরুষ উভয়ই বাসা তৈরি করে, বাচ্চাদের খাওয়ায়। গাঢ় দাগসহ হালকা সবুজ বা জলপাই রঙের ৫-৬টি ডিম পাড়ে। পালাক্রমে দুজনই ডিমে তা দেয়। কোকিলরা বাসা বানায় না, প্রায়শ কাকের ডিম ফেলে দিয়ে ওদের বাসায় ডিম পাড়ে। কাকের প্রজাতি সংখ্যা ৪৩টি। এরমধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে দুটি। একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া প্রত্যেক মহাদেশেই আছে কাকের প্রজাতি।
সহযোগিতার আহ্বান...
ব্যস্ত এই পৃথিবীর প্রতিদিনকার শোরগোলে হারিয়ে যায় শত গল্প, না শোনা থেকে যায় হাজারো কথা। অগণিত বন্যপ্রজাতির ক্ষেত্রেও দৃশ্যটি ভিন্ন নয়। ছোট, বড়, বিপন্ন, বন্যজীবনের জটিলতা ও আকর্ষণীয় গল্পগুলোই আমাদের লেখকদের মূল আগ্রহ। প্রতিটি মুহুর্ত আমরা কাটাই এসবের সন্ধানে। পরিবেশ, বন্যপ্রাণী এবং বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিকতা কেবল মাত্র ভালোবাসার টানে শুরু করলেও, নিউজরুম পরিচালনায় প্রতিনিয়ত হার মেনে যায় এই আবেগও। এমন সময় প্রয়োজন হয় সহযোগিতার।
প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ছবি, ভিডিও এবং তথ্য তুলে ধরার ইচ্ছে নিয়ে পৃথিবীজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণকারী গবেষক, গবেষণা সংস্থা ও সংরক্ষণকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছি আমরা। জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করি বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণ-বৈচিত্র্যের তথ্যচিত্র। ওয়েবসাইট ও ম্যাগাজিন দৃষ্টিকটু বিজ্ঞাপনে যাতে ভর্তি হয়ে না থাকে, প্রতিনিয়ত আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এতে পাঠকের স্বাচ্ছন্দ্য বজায় থাকলেও, আয়ের একটি বড় অংশ কমে যায়। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোভিড-১৯ কালীন অর্থনৈতিক সংকট। তাই আমাদের লেখকদের যথাযথ সম্মানীর পাশাপাশি বিজ্ঞাপনী আয়ের ক্ষতিপূরণের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানাই। এগিয়ে যেতে চাই একই উদ্দ্যোমে, সঙ্গে চাই আপনাদের সহযোগিতা।
যোগাযোগ: info@bengaldiscover.com