
ভূমিকম্পে শনিবার কেঁপে উঠলো পশ্চিমবঙ্গ। উৎপত্তিস্থল ছিল হাওড়া, তাও ভূ-গর্ভের মাত্র দশ কিলোমিটার নিচে। এর মাত্র ছ’দিন আগে কাঁপলো পুরুলিয়া। আর দক্ষিণবঙ্গে গত এক বছরে লেগেই ছিল একাধিক ভূমিকম্প।
এতো ভূ-কম্পনে জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্কও। হাওড়ায় ভূকম্পনের তীব্রতা ছিল ৩ দশমিক ৬। আর গত শুক্রবার মণিপুরের চান্দেলেও হয় ৩.৫ মাত্রার ভূমিকম্প, রোববার দক্ষিণবঙ্গে পুরুলিয়ায় কম্পনে মাত্রা ছিল চার।
গত ২৬ মে বাঁকুড়ায় কম্পনের মাত্রা ছিল ৪.৮। গেলো বছরের আগস্টে হুগলির খণ্ডঘোষেও ভূমিকম্পে মাত্রা ছিল পাঁচ।
ভূ-কম্পন নিয়ে সাম্প্রতিক সমীক্ষা মতে, বেঙ্গল বেসিনের কাদামাটির স্তরের উপরে দাঁড়িয়ে কলকাতা। নেপালের ভূমিকম্পেও কলকাতাতে অনুভূত হয়েছিল কম্পন। তাই কলকাতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভূ-বিজ্ঞানীরা।
ভারতের উত্তরে ভূকম্পপ্রবণ হিমালয় এবং কলকাতার নীচে ইয়োসিন হিঞ্জ জোন। আর কলকাতার আশেপাশে পিংলা, দেবগ্রাম-বোগরা, গড়ময়না-খণ্ডঘোষ, রাজমহল ফল্ট, ধাক্কা আসতে পারে পুরুলিয়া শিয়ার জোন থেকেও।
বেঙ্গল বেসিন রয়েছে ৭.৫ কিলোমিটার পুরু কাদামাটির স্তরের ওপর। কম্পন কাদার ওপর একবার ঢুকে পড়লে, তা ঘুরতেই থাকে। ফলে বাড়তে থাকে তীব্রতা।
এতে কাদামাটি গলে কলকাতা শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা ধসে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে জানান গবেষকরা। পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি- (আইআইটি) এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণাও করে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূতত্ত্ব ও ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথ আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান, শনিবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। কলকাতার মাটির সাড়ে চার কিলোমিটার তলা দিয়ে ‘ইয়োসিন হিঞ্জ’ বা ‘ময়মনসিংহ-কলকাতা হিঞ্জ’ রয়েছে। সেই হিঞ্জ লাগোয়া এলাকাতেই হয়েছে কম্পটি।
ভূমিকম্পের প্রাবল্য নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (বিএসআই)।
ওই সমীক্ষায়, ভূমিকম্প প্রবল পাঁচটি অঞ্চলে (জোন) ভাগ করা হয়েছে ভারতকে। এতে সবচে বিপজ্জনক পাঁচ নম্বর জোন কাশ্মীর, পাঞ্জাব, গুজরাটের কচ্ছ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো।

অপেক্ষাকৃত কম চার নম্বর জোনের মধ্যে পড়ছে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ জেলা। কলকাতা আর সংলগ্ন এলাকা রয়েছে তিন নম্বর বিপজ্জনক জোনের মধ্যে। তিন নম্বর জোনের মধ্যে থেকেও কলকাতায় ভূকম্পের তীব্রতা বেশি হয় না, ভূতাত্ত্বিক বিশেষ গঠনের কারণে।
ভূ-বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ‘ইয়োসিন হিঞ্জ’-এ যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, এতে হতে পারে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প।
যদিও অধ্যাপক শঙ্করকুমার নাথ বলেন, ‘‘একদিক থেকে এই ছোট ছোট ভূমিকম্প ভাল, শক্তিক্ষয় হয়ে যায়।’’
ভূমিকম্প হলে কলকাতার কোথায় কতটা ক্ষতি হবে তা জানতে সমীক্ষা ভারতের ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়। যেটি পরিচালনা করে খড়্গপুর আইআইটি।
সমীক্ষায় উঠে আসে, পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায় ভূমিকম্প হলে সবচে বেশি প্রভাব পড়বে সল্টলেক, রাজারহাট, নিউ টাউন, দমদম, সিঁথি, পাইকপাড়া, শ্যামবাজার, বেলেঘাটা, পার্ক স্ট্রিট, কসবা, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, বেহালা, তারাতলা, মেটিয়াবুরুজ, আলিপুর, হাওড়া, বানতলা ও বকডোবা। আর রাতে ভূমিকম্প হলে সবচে বেশি ক্ষতি হবে সল্টলেক, বেহালা, নিউ টাউন ও হাওড়ার কিছু অংশ।
একাধিক সংস্থার তথ্যমতে, অপরিকল্পনিত নগরায়ন। নিয়ম না মেনে বাড়ি তৈরি, পুরনো বাড়িরও সংস্কার না হওয়ার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য।
ক্রমর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ এবং শহরের পানির স্ত নেমে যাচ্ছে দ্রুত। ভূমিকম্প হলে তাই ধসে যেতে পারে কলকাতার একটি বড় অংশ।
বিভিন্ন গবেষণায় কলকাতায় ঘন ঘন ভূমিকম্পের জন্য বহুতল ভবন ও মেট্রো রেলকে দায়ী করা হয়েছে। সমীক্ষা মতে, গঙ্গা নদীর তলদেশ থেকে মেট্রো টানেল নির্মাণে কলকাতার ভূমির ভারসাম্য পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। গঙ্গার তলদেশে গুরুত্বপূর্ণ যে ফল্ট লাইন আছে তা পলিমাটিতে এতদিন চুপচাপ ছিল।
তবে মেট্রোরেলের লাইন যাওয়াতে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে ভূমি। ফলে দ্রুত গতিতে জোন টু থেকে জোন ফোর-এর ভূমিকম্প বেল্টে চলে গেছে কলকাতা। তাই আগামীতে আরো বড় ভূমিকম্প আশঙ্কাও রয়েছে কলকাতায়।