বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর কারণে চলছে লকডাউন। এতে পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রতিবেশে দৃষ্টিনন্দন পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার কমে যাওয়ায় বিশ্বের বায়ুমানের উন্নতি হয়েছে। সবচে বেশি কার্বন নি:সরণকারী দেশ চীনে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কার্বন নি:সরণ হ্রাস পেয়েছে। উহান, ঢাকা, দিল্লির মতো দূষিত শহরগুলোতে বুকভরে নি:শ্বাস নিচ্ছে মানুষ। অপেক্ষাকৃত দূষণ কম হওয়ায় বড় বড় নদীগুলোর পানি দুর্গন্ধও কমেছে।
ঢাকার আশপাশের চার নদীতেও শিল্পবর্জ্য কম পড়া এবং নৌ চলাচল বন্ধ থাকায় পানিতে দূষণ কিছুটা কমেছে। সাধারণত এই সময় (ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ) দেশের নদ-নদীর জন্য শুকনো মৌসুম। একদিকে এই মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকে, সঙ্গে শহর ও নগরের শিল্পবর্জ্য ও অপরিশোধিত পয়ো:বর্জ্য সরাসরি নদীগুলেতে ফেলা হয়। ফলে নদীতে মাছসহ জলজ প্রাণীর টিকে থাকার মতো স্বাস্থ্যকর জলীয় পরিবেশ চিন্তা করাও প্রায়ই অসম্ভব। তারপরও এই মৌসুমে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষা নদীতে মাছ ধরতে জাল ফেলেন জেলেরা। কিছু মাছ পাওয়াও যায়।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢাকার তুরাগ নদে ডলফিনের সাতার কাটার খবরও উঠে এসেছে। এই সুন্দর খবরটি ফেসবুকে শেয়ারও দিচ্ছেন অনেকে। ভাবছেন কোভিড-১৯ এর চলমান লকডাউনের কারণেই ঢাকার বায়ুমানের মতই নদীতেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। এই খবরের সাথে ভারতের গঙ্গায়, কলকাতায় ও উত্তর প্রদেশের কিছু নদীতে ডলফিনের সাতারের কিছু খবরও চাওড় হয়েছে।
আমি ঢাকা বিভাগের নদীগুলোর বেইজলাইন গবেষণার কাজে যুক্ত আছি। তাই এই শুকনো মৌসুম তথা ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় আমার দলসহ আমাকে নদীতেই থাকতে হয়। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ফিল্ড ওয়ার্ক এখন বন্ধ, কিন্তু নদীর খবর আমি নিত্য অবগত। নদীপাড়ের জেলে, মাঝিরা আমার বন্ধুর মতই। তাদের সহযোগিতায় এই জরুরি পরিস্থিতেও আমি যথেষ্ট একটিভ।
এবার আসি ঢাকার নদীতে ডলফিনের বিচরণ নিয়ে। সিন্দু, গঙ্গা, ইয়াংজি, আমাজন, ইরাবতী, সহো মহানদীগুলো এবং এর শাখা নদীতে মিঠা পানির ডলফিন দেখা যায়। গঙ্গা-ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা মহা-নদীর বেসিন এলাকায় পৃথিবীর ১৫ শতাংশের বেশি জনসংখ্যার পাশাপাশি মিঠাপানির ডলফিনেরও বসবাস। বিশেষ করে অতি জনসংখ্যার বিচরণ ও মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের প্রভাবে গঙ্গা-ব্রক্ষপুত্র-মেঘনা বেসিন এলাকায় গাঙ্গেয় ডলফিন সংখ্যার হ্রাস উদ্বেগজনক (৫০০০-৬০০০ ডলফিন ১৯৮০ সালে, বর্তমানে ২৫০০)। এরমধ্যে ভারত অংশের নদীতে প্রায় ১৮০০ ডলফিন (গাঙ্গেয়/গঙ্গোত্রি ডলফিন) দেখা যায়।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবেই বদ্বীপ অঞ্চল, যার বুক জুড়ে অসংখ্য নদী, খাল, বিল, ও প্লাবন ভূমি থাকায় বাংলাদেশে গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতি ডলফিন এখনো অনেক দেখা যায়। ডলফিন জলজ খাদ্য-শৃঙ্খলের তৃতীয় স্তরের জীব যা আমাদের নদীর জলজ প্রাজাতির সূচকের মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। গাঙ্গেয় ডলফিনের উপস্থিতি নদীগুলোর স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার ফ্ল্যাগশিপও বলা চলে। কারণ যখন নদীতে ডলফিন দেখা যায় তখন বোঝা যায় নদীর অন্যান্য প্রাণী ও মাছ সুরক্ষিত আছে। ডলফিনের উপস্থিতি নদী নির্ভর জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে। কারণ এ দেশের এক কোটি ২০ লাখ মানুষ সরাসরি নদী নির্ভর। আর নদীর সু-স্বাস্থ্যই এই জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। যা ডলফিনের উপস্থিতি মাধ্যমে নদীময় জনগোষ্ঠী বিচার করে থাকেন।
জেলেদের জন্য মিঠাপানির ডলফিন, বিশেষকরে গাঙ্গেয় ডলফিন নদীতে এক আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করে। ডলফিনের উপস্থিতি জেলেদেরকে বড় ও বিভিন্ন আকারের মাছের উপস্থিতি জানান দেয়। সঙ্গে জেলেদের মাছ শিকারেও সহায়তা করে। ডলফিন নদীতে জেলেদের নৌকার সাথে সাতার কেটে, খেলা করে এবং তাদের মাছ ধরার সময় ছোট-বড় মাছগুলোকে একদিকে জড়ো করে তাড়া দেয়। যা জেলেদের জালে ধরতে সহায়তা করে। প্রাণীদের উপস্থিতি মানে বড় বড় মাছেরও উপস্থিতি। জেলেরা মাছ ধরার সময় কোন ডলফিনকে সঙ্গে পেলে নিজেদের ওইদিন ভাগ্যবান মনে করেন। নদীর রোগা মাছের দমন ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রাণীটির ভূমিকা অনন্য।
সুন্দরবন ছাড়াও দেশের বড়াল নদীর সিলন্দা থেকে নাগদেরমা এবং যমুনা নদীর নগরবাড়ি থেকে মোহনগঞ্জ অংশকে ডলফিনের আভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে সরকার। যমুনা নদীর অংশের গাঙ্গেয় ডলফিনগুলো যমুনা নদী ও এর সংযুক্ত প্রায় সকল ছোট-বড় নদীতেই মাছ ধরতে ও সাতার কাটতে দেখা যায়। বিশেষ করে যে নদীতে জোয়ার-ভাটার প্রভাব বিদ্যমান সে নদীতে শুকনো মৌসুমেও ডলফিনের উপস্থিতি রয়েছে। আমি নিজ গবেষণার কাজে যতবারই নদীতে গিয়েছি ঢাকা, গাজিপুরের বংশি, ধলেশ্বরী, মানিকগঞ্জ, শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গার ডাউন স্ট্রিম, ইছামতি, বালু,ও যমুনা নদীতে প্রতিদিনই ডলফিন (স্থানীয় নাম- শুশক/শিশু মাছ/শিশু ওপ মাছ/হোপ মাছ, হাউমাছ/শীশূক/ঠুস/হোচ্ছুন) দেখায় সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
শুকনো মৌসুমে সাধারণত নদীর স্রোতের বিপরীতে ও নদীর মাঝ বরাবর, কখনো নদীর বাঁকে জোড়ায় জোড়ায় কিংবা একাকী বা কখনো বাচ্চাসহ দেখা যায় ডলফিন। আর বর্ষায় মূল নদী থেকে বের হয়ে নদীর প্লাবন ভূমি ও বিলে মাছ শিকারেও দেখা যায় ডলফিনদের। বর্ষায় বা জোয়ারের সময় এরা মাছদেরকে তাড়িয়ে বিল ও ডাঙার দিকে নিয়ে যায়। আর ভাটার সময় জেলেরা বিলে বেড়ি জাল দিয়ে অনেক মাছ শিকার করে। ডলফিনের সাথে মানুষের জীবন-জীবিকা ও জল-খেলাধুলার সম্পর্ক হাজার বছরের। হাজার বছর পুরনো হিমালয় ও কাছিম-কুমিরের বয়সী আদিম মিঠাপানির এই মানুষের বন্ধু প্রানীটি শুকনো মৌসুমে নদীর মূল প্রাবাহে নেমে আসে।
তবে ঢাকার চারপাশের নদীতে দূষণ বেশি হওয়ায় এখন সাধারণত ডলফিন কম দেখা মিলে। প্রতি দুই মিনিটে একবার শ্বাস নিতে জলের উপরে উঠতে হয় ডলফিনকে। কিন্তু নদীর পানির গুণগত মান ঠিক না থাকায় এবং মাছের উপস্থিতি না থাকায় বেশিদিন নোংরা পানিতে ডলফিন টিকে থাকতে পারে না। তাই এ মৌসুমে ঢাকার ডলফিনরা ধলেশ্বরী, মেঘনা ও যমুনা নদীতে চলে যায়।
যেহেতু ঢাকার চার নদীতে এখনো জোয়ার-ভাটার প্রভাব এখনো আছে, তাই এই মৌসুমেও তুরাগের বছিলা ব্রিজ থেকে আশুলিয়া এলাকা, টঙ্গি বিল (আশুলিয়া ব্রিজের দক্ষিণের অংশের বিলে, বুড়িগঙ্গার জাজিরা এলাকা, ধলেশ্বরী নদী, বংশী, মানিকগঞ্জের বংশী, কালিগঙ্গায় এবং শীতলক্ষ্যায় ডলফিনের দেখা পাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। যমুনা নদীর উভয় অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় ডলফিন।
যারা আজকাল তুরাগ নদীতে ডলফিন দেখে কোভিড-১৯ এর প্রভাব মনে করছেন, সেটি ভুল ধারণা। এমনকি ভারতের নদীগুলোতেও ডলফিনের আনাগোনা স্বাভাবিক। তবে এ দেশ থেকেও ভারতের গঙ্গায় দূষণ তুলনামুলক বেশি হওয়াতে লকডাউনের এ সময়ে নদীর স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো বলা যেতে পারে। তবে লকডাউনে ডলফিনের সাতার কাটার ক্ষেত্রে তেমন সরাসরি কারণ হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ ও ভারতের নদীগুলোর দূষণের প্রকৃতি এবং তীব্রতা এতই বেশি যে, কয়েকদিনের লকডাউনেও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নদীতে আসেনি। আর আসা সম্ভবও নয়।
বাংলাদেশে এই মৌসুমে এখনো নদীগুলোতে সচরাচর ডলফিন দেখা যায়। এজন্য আপনাকে অবশ্যই নদীতে যেতে হবে। আবহাওয়াগত কারণে এখন নদীতে নতুন জীবনের শুরু হবার কথা। সপ্তাহখানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, আমরা জানি নদীর জন্ম অথবা পুনর্জন্ম হয় এপ্রিলের বৃষ্টির পরেই। এ সময় নদীর নতুন পানি ও প্রবাহের সঙ্গে জলজ জীবনের এক আমুল পরিবর্তনের আসে। ফলে জলের থার্মোমিটার ডলফিনের আনাগোনা স্বভাবতই সবার আগে দেখা যাবে। এদের উপস্থিতি দিবে নদীতে নতুন জীবনের বার্তা।
কোভিড-১৯ লকডাউনের ফলে শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নগরের পয়ো:বর্জ্য ও প্ল্যাস্টিক দূষণ থেকে আমাদের শহরের নদীগুলোকে এখনো মুক্ত করতে পারিনি। দূষণ থেকে নদীকে মুক্ত করতে না পারলে হাজার বছরের প্রবীণ বন্ধু ডলফিনদের বেচে থাকার পরিবেশও আর টিকে থাকবে না।
লেখক: নদী গবেষক ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল।
ইমেইল: ezazbd@gmail.com
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।