জলাতঙ্ক চার হাজার বছরের পুরনো রোগ। কুকুর, বিড়াল, শিয়াল, বেজি, বানর ও বিভিন্ন বন্যপ্রাণির আঁচড়-কামড়ের ফলে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৯৬ শতাংশ জলাতঙ্ক সংক্রমণের জন্য কুকুর দায়ী।
বিশ্ব প্রাণি-স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় প্রধান কর্মকৌশলগুলো হচ্ছে- সার্ভিল্যান্স ও রিপোর্টিং, ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদান, বেওয়ারিশ কুকুর বন্ধ্যাকরণ, কুকুরের অভিভাবকত্ব প্রসারণ এবং শিক্ষা ও জনসচেতনতা সৃষ্টি। যুগোপযোগী সার্ভিল্যান্স ও রিপোর্টিং ছাড়া জলাতঙ্ক সম্পর্কিত সঠিক রোগতত্ত্ব বিচার বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। ব্যাপকহারে কুকুর টিকাদানের মূল লক্ষ্য হার্ড ইম্যুনিটি সৃষ্টি। এজন্য নির্দিষ্ট এলাকার মোট কুকুর সংখ্যার ৭০ শতাংশ টিকার আওতায় আনার প্রয়োজন পড়ে। বেওয়ারিশ কুকুর বন্ধ্যাকরণের উদ্দেশ্য তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব (মালিকানা) প্রসারণ এবং শিক্ষা ও জনসচেতনতার মাধ্যম ঠিক সময়ে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে পুরানো আমলের ‘ঝাড়ে–বংশে নিধন’ পরিস্থিতির প্রকোপ থেকে জলাতঙ্কগ্রস্থ মানুষ, প্রাণি উভয়কে বাঁচানো সম্ভব।
বাংলাদেশে বেওয়ারিশ কুকুর বেশি কেন?
এ দেশের ৮৩ শতাংশ কুকুর বেওয়ারিশ, মুক্ত-ভবঘুরে। প্রথমত সুপরিকল্পিত খাদ্যবর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। যেখানে সেখানে ডাস্টবিন ও উচ্ছিষ্ট খাবার। পরিবেশে এরকম খাদ্যবর্জ্য’র উপস্থিতি বেওয়ারিশ কুকুরের প্রাকৃতিকভাবে টিকে থাকার পক্ষে সহায়ক। দ্বিতীয়ত কুকুরের সংখ্যাধিক্য প্রজনন বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ অতিরিক্ত লিটার সাইজ। কুকুরে প্রতি প্রসবে বাচ্চার সংখ্যা অনেক বেশি। জাত ভেদে একটা কুকুরী ১-১২ পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। অন্যদিকে একটা কুকুরের প্রজননক্ষম হতে মাত্র ছয় মাস সময় লাগে এবং কুকুরীর গর্ভকাল প্রায় দু’মাস। তৃতীয়ত আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্ট্যাটাসের কথা ভেবে পোষার জন্য দেশিয় জাতের কুকুরের প্রতি অনাগ্রহ। এজন্যই দেখা যায় বেওয়ারিশ কুকুর মাত্রই দেশি জাতের।
কুকুর নিধন বা অপসারণ নয় কেন?
এ কথা অনস্বীকার্য, জলাতঙ্ক প্রতিরোধে একসময় মধ্যযুগীয় বর্বর কায়দায় নির্বিচারে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন করা হতো। এই পদ্ধতি যে কেবল নিঃসন্দেহে অমানবিক তা কিন্তু নয়; বৈজ্ঞানিকভাবেও অকার্যকর। নির্বিচারে কুকুর নিধনে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের জীবতত্ত্বিক ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। তখন পাশের টেরিটোরি থেকে নতুন কুকুরের অভিবাসন ও স্থানান্তর ঘটে। এছাড়া ইঁদুর, শেয়াল, নেকড়ে জাতীয় প্রাণিগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে পারে। তখন প্লেগের মতো ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যেতে পারে। এজন্য পূর্বের পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য নতুন কুকুরগুলোর প্রজননহার প্রাকৃতিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং দেখা গেছে, ঐ সময়ে কুকুরের বাচ্চাবস্থায় মৃত্যুর হারও হ্রাস পায়।
নির্দিষ্ট এলাকা থেকে কুকুর বিতাড়ন/স্থানান্তর/অপসারণেও একই ফলাফল। এক্ষেত্রে নতুন টেরিটোরিতে আধিপত্য দখল ও খাদ্য সংকট কেন্দ্রিক অস্বাভাবিক কুকুর লড়াই হয়। এরকম উচ্ছৃঙ্খল আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি কুকুর, মানুষ উভয়ের পক্ষে অসহনীয়। নিধন, অপসারণে ব্যয়ও কম নয়। কাজেই বেওয়ারিশ কুকুর ব্যবস্থাপনায় তাদের নৃশংস নিধন বা অপসারণ কোন স্থায়ী সমাধান নয়। এতে তাদের সংখ্যা আপাতত কমছে মনে হলেও পরবর্তীতে উল্টো বেড়ে যায়। ‘প্রাণিকল্যাণ আইন, ২০১৯’ এর ধারা ৭ অনুযায়ী নির্বিচারে মালিকবিহীন প্রাণি নিধন বা অপসারণ দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত। এই ধারার উপ-ধারা (২) অনুযায়ী অপরাধী ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
কেন বন্ধ্যাকরণ?
একমাত্র বন্ধ্যাকরণই বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যাধিক্য হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের টেকসই এবং বিজ্ঞানসম্মত সমাধান। এ পদ্ধতি আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। এই পর্যন্ত বিশ্বে যতগুলো দেশ জলাতঙ্ক মুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, প্রত্যেকটি দেশ জলাতঙ্ক প্রতিরোধে বেওয়ারিশ কুকুরে বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
বন্ধ্যা করলে কুকুরের স্বভাব ও আচরণে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। গতি প্রকৃতি কিছুটা শান্ত হওয়াতে পরবর্তীতে ব্যাপকহারে টিকা কার্যক্রমের সময়ে তাদের ধরা ও নিয়ন্ত্রণের কাজটি বেশ সহজসাধ্য হয়। এতে টিকা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য ৭০ শতাংশ বেওয়ারিশ কুকুরকে টিকার আওতায় আনা সহজতর হয় এবং সংখ্যাধিক্য নিয়ন্ত্রিত থাকায় টিকার খরচ ও সময় কমে।
বন্ধ্যাকরণের ফলে বেওয়ারিশ কুকুরের স্বাভাবিক আক্রমণ-প্রবণতা যেমন- কুকুর-কুকুরে লড়াই ও মা কুকুরী কর্তৃক বাচ্চাদের সুরক্ষার্থে আক্রমণ প্রবণতা এবং হরমোনজনিত বিভিন্ন আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। ফলে কুকুর দ্বারা আক্রমণের ঘটনা কমে, কমে কুকুর-মানুষ বৈরীতা। বেওয়ারিশ কুকুর বন্ধ্যাকরণের মাধ্যমে কুকুরের প্রজনন মৌসুমে কুকুর কর্তৃক কামড়-আঁচড়ে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে আনা সম্ভব। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে গেলে জলাতঙ্কজনিত ঝুঁকি কমবে এবং পোস্ট এক্সপোজার প্রফাইলেক্সিস ও র্যাবিস ইমিউনুগ্লোবুলিন বাবদ চিকিৎসা খরচে সাশ্রয় হবে।
বন্ধ্যাকৃত বেওয়ারিশ কুকুরে সংক্রামক যৌন রোগ (যেমন- সিটিভিটি, ব্রুসিলোসিস) থেকে নিষ্কৃতি পায়। ফলে কুকুরের মঙ্গল হয়, সুস্থ থাকে এবং তাদের আয়ুষ্কাল বাড়ে। বন্ধ্যাকৃত কুকুরের টেরিটোরি রেঞ্জ তুলনামূলক সীমিত হয়, ফলে কুকুর-শেয়াল সংঘাত অনেকটা নিয়ন্ত্রিত থাকে। এভাবে শেয়াল থেকে কুকুরে জলাতঙ্ক ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
বন্ধ্যাকৃত কুকুরের ডাক তুলনামূলক কম কর্ষশ ও মাত্রা-সহনীয় হয়, অল্পে উত্তেজিত হওয়ার প্রবণতা কমে। সর্বোপরি স্বভাবে শান্ততর প্রকৃতির কারণে সমাজে বন্ধ্যাকৃত কুকুরের গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর বাড়ে। বন্ধ্যাকৃত বেওয়ারিশ কুকুরের মেজাজ-মর্জি বন্ধুভাবাপন্ন থাকায় তারা মানুষ কর্তৃক কম নিগ্রহের শিকার হয়। সমাজে প্রাণিকল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
সম্প্রতি এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, টিকাপ্রাপ্ত কুকুরের শরীরে জলাতঙ্ক প্রতিরোধী এন্টিবডি টাইটার লেভেল- বন্ধ্যা করা হয় নি এমন কুকুরের চেয়ে বন্ধ্যাকৃত কুকুরে চারগুণ বেশি। কাজেই আন্তর্জাতিক প্রাণিকল্যাণ স্ট্যান্ডার্ড মেনে জলাতঙ্ক প্রতিরোধে কুকুর টিকা প্রদানের পাশাপাশি শহর ও উপশহর এলাকার বেওয়ারিশ কুকুর বন্ধ্যাকরণ অত্যন্ত জরুরি।