
ছোট-বড় সকল শ্রেণির মানুষের কাছে পরিচিত এ পতঙ্গ। শহর ও গ্রামে ফড়িং নিয়ে আছে নানা গল্প ও ছড়া। ফড়িংয়ের পেছনে ছুটে বেড়ানোর গল্প, কিংবা মজার স্মৃতি আছে হয়তো অনেকেরই। আর ফড়িংয়ের উড়াউড়ি ভালো লাগে না এমন মানুষও খুব কমই আছে। কিন্তু এখন কি আগের মত দেখা যায় ফড়িং? আগের মতো কি আছে পতঙ্গটি? সকলের অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে না তো প্রিয় এই প্রাণিটি?
ফড়িং বা সূচ ফড়িং, জল ও স্থল উভয় স্থানে জীবনচক্র সম্পন্ন কারী Amphibious একটি পতঙ্গ। Odonata/ওডনাটা পরিবারের অন্তর্গত ফড়িং-Dragonfly এবং সূচ ফড়িং-Damselfly মেসোজোয়িক ইরাতে উৎপাত্তি লাভ করে, সে অনুযায়ী পৃথিবীতে অন্যতম প্রাচীন প্রাণী হিসেবে পরিচিত।
Odonata শব্দের অর্থ দাঁত, আক্ষরিক অর্থে ম্যান্ডিবল বা নিম্ন চোয়ালে শক্ত দাঁত সম্পন্ন প্রাণি। এদের সাধারণত প্রিডেটরি ইনসেক্ট হিসেবে ধরা হয় এবং এরা অন্য পতঙ্গ এমকি অন্য ফড়িংদেরও শিকার করে খেয়ে থাকে। তাই এদের নিচের ম্যান্ডিবল ধারালো ও প্রচুর শক্ত। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত এদের মোট প্রজাতির সংখ্যা ছয় হাজার ৩৩৭ট।
দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের এই বাংলাদেশে ফড়িংয়ের উপস্থিতি রয়েছে চোখে পড়ার মতো। এদের বর্ণিল বর্ণচ্ছটা বাড়িয়ে দিয়েছে এদেশের সৌন্দর্য্যকে বহুগুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১০৩টি ফড়িং প্রজাতি (৫৮টি ফড়িং এবং ৪৫টি সূচ ফড়িং)। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সংখ্যা ১৫০ এর বেশি হতে পারে – যদি গবেষণার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশে সাধারণত ফড়িং এবং সূচ ফড়িংকে ফড়িং নামেই ডাকা হয়, কোথাও কোথাও ঝিলে পোকা, ঝিলে হিসাবেও ডাকা হয়। সাধারণত জলাশয়ের আশেপাশেই সব থেকে বেশি ফড়িং বা সূচ ফড়িংয়ের দেখা মেলে। এই পতঙ্গের জীবনচক্র তিন ভাগে বিভক্ত- ডিম, লার্ভা এবং পূণাঙ্গ অবস্থা। এরা সাধারণত পানিতে ডিম পারে, পরবর্তীতে লার্ভা দশায় উপনিত হয়, এই লার্ভা সাধারণত জলজ এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় স্থলজ।
উপরোক্ত তথ্য থেকে বোঝা যায়, ফড়িংয়ের আবাসস্থল হিসেবে জলজ ও স্থল পরিবেশ এবং প্রতিবেশ ব্যবস্থা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এ দেশের পরিবেশ বর্তমানে ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। জলাশয়ের দূষণ, পানির গুনগত মানের পরিবর্তন, জলাশয় ভরাট ও জলজ উদ্ভিদের ক্রমহ্রাসমান অবস্থা নষ্ট করছে ফড়িংয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশকে।
আমার নিজের পর্যবেক্ষণের কথাই যদি বলি, ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেরকম বিভিন্ন প্রজাতির ফড়িংয়ের দেখা পেতাম, তা ২০২৩ সালে এসেও সংখ্যা অনেক কম। ঢাকার বাইরের জেলা ফরিদপুরেও একই অবস্থা। এমন কি গ্রামগুলোতেও দেখা যাচ্ছে আগের মতো জলাশয়গুলোর গুনগত মান ঠিক নেই! সেখানেও বেড়ে গেছে জলজ পরিবেশ দূষণের মাত্রা। কীটনাশকের ব্যবহার অতিরিক্ত মাত্রায় নষ্ট করছে জলজ পরিবেশে। অগোচরেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্য এই ফড়িংরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও দৃষ্টি হয়তো সেদিকে নেই। মেগাফনা সংরক্ষণ জরুরি কিন্তু পাশাপাশি পরিবেশের সুস্থতার নির্দেশক এই প্রাণীগুলোর উপর গুরুত্ব দেয়া দরকার।
এছাড়াও এখন প্রয়োজন ফড়িং নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার সাথে পতঙ্গটির সম্পর্ক নির্ণয়, কোন কোন জলজ পরিবেশের সুস্থতার নিয়ামকের সাথে এদের সম্পর্ক তা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করা। না হলে অচিরেই সুন্দর বর্ণিল ডানার এই পতঙ্গ হারিয়ে যাবে এ দেশের পরিবেশ থেকে। এতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষ। পরবর্তী প্রজন্ম যেন মুক্ত আকাশে ফড়িংয়ের উড়ে বেড়ানো উপভোগ করতে পারে ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পারে সেজন্য ফড়িংয়ের মতো পতঙ্গ সংরক্ষণ খুবই জরুরি।
লেখক: বন্যপ্রাণ বিষয়ক গবেষক, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ।