
ছোট ছোট ছড়াকে কেন্দ্র করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল একেকটি পাহাড়ি পাড়া। তাই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাড়াগুলোর নামও ঝিরি,ঝর্ণা কিংবা ছড়াকেন্দ্রিক।
চোংড়াছড়ি, বড়ইছড়ি, কুতুকছড়ি, ঘিলাছড়ি, বগাছড়ি ও ঠাকুছড়া ইত্যাদি এলাকা ছড়ার নামেই বেশ পরিচিত।
পার্বত্য অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র, বসবাসকারীদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে পানিপ্রবাহের উৎসগুলো। তবে বদলেছে সময়, নানান কারণে বিলুপ্তির পথে পাহাড়ের সেই ঐতিহ্যবাহী ছড়া, ঝিরি-ঝর্ণাগুলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার নামও ছড়াকেন্দ্রিক। যেমন- মহালছড়ি, মাইচছড়ি, খাগড়াছড়ি, মানিকছড়ি, সিন্দুকছড়ি ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ছড়া, ঝর্ণা ও নদী মৃতপ্রায়।
আর আশঙ্কাজনক হারে কমছে খাগড়াছড়ি জেলায় চেংগী নদী, মাইনী নদী, বান্দরবান জেলায় মাতামুহুরী, সাংগু নদী এবং সুয়ালক নদীর পানির প্রবাহ।

রাঙামাটি শহর থেকে মাত্র সাত-আট কিলোমিটার দূরের গ্রাম মগবান। এই গ্রামেরই জুমচাষী জ্যাকব চাকমা। তিনি জানান, ছড়া বা ঝর্ণার পানিই ছিল পান করার মতো একমাত্র উৎস। এখন আর আগের মতো কিছুই নেই।
“আমরা মানুষরাই না, বনের পশু-পাখিরাও কষ্ট পাচ্ছে পানির অভাবে,” উল্লেখ করেন জ্যাকব।
গবেষকদের মতে, প্রকৃতির এই বদলের যাওয়ার প্রভাব এখন বেশিই দৃশ্যমান পাহাড়িদের জীবন জীবিকায়।
পাহাড় বিষয়ক গবেষক শাওন ফরিদ বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চরম জল সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে হয়তো জলের জন্য যুদ্ধ করতে হবে।”
“এতে বদলেও গেছে পাহাড়বাসীদের খাদ্যাভ্যাসও,” বলেন শাওন ফরিদ। অতীতের চিত্র উল্লেখ করে আরো বলেন, “আগে পাহাড়ের নিচু এলাকায় মাটি খুঁড়লে পরিস্কার ঠান্ডা পানি মিলতো। যা খাবার পানির যোগান দিতো, এখন আর পাওয়া যায় না।”

“এসব কিছুই যেন মিছে দু:স্বপ্ন অতীত। এর জন্য দায়ী কে? আর কে, আমরা লোভী মানুষ,” বলেন গবেষক শাওন ফরিদ।
পাহাড়ের ভূ-অবকাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে দিনদিন। গবেষকরা জানান, ছোট-বড় পাথর তুলে নেয়া হচ্ছে। মৌজা রিজার্ভও এক প্রকার নেই বলা যায়। প্রাকৃতিক বন, সংরক্ষিত বন, জলারবন যা অবশিষ্ট আছে তা নামেমাত্র। তাই পাহাড় সংরক্ষণে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন গবেষকরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন বিষয়ককর্মী অম্লান চাকমা বলেন, ‘বন উজাড়, জীব-বৈচিত্র ধ্বংস, তামাক চাষ, রাবার, সেগুন বাগান- ইত্যাদি কারণেও বিনষ্ট হচ্ছে পাহাড়ে পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো।
আদিবাসী গবেষক ঞ্যোহলা মং মতে, ছড়া-ঝিড়ি বা ঝর্ণা সঙ্গে মিশে আছে আদিবাসী জীবনের গল্প এবং লোককাহিনী। যা এক সময় হয়তো হারিয়ে যাবে। তিনি বলেন, পাহাড়ে বনায়নের নামে একক প্রজাতির বৃক্ষ রোপন বন্ধ করতে হবে, এটি পার্বত্য ভূমির জন্য ক্ষতিকর।