
বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই একসময় প্রচুর বাঘ ছিল। খুব বেশি আগে না, পঞ্চাশ-ষাট বছর পিছিয়ে গেলেই দেখা যায় বাংলাদেশের অনেক প্রান্তিক বনেই এরা রাজত্ব করে বেড়াত। মধুপুরের জঙ্গলের কথাই বলি, সুষঙের জমিদার চল্লিশের দশকেও শালবনে বাঘ মারেন।
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল গেলে লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় শিহরিত হন অনেকে। এই লাউয়াছড়াতেও বাঘেরা মহাদর্পে ঘুরে বেড়াত একসময়। ১৯৬২ সালে লাউয়াছড়ায় বাঘ মারেন এক পাকিস্তানি জেনারেল। মাচায় বসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটি মারেন ভদ্রলোক।
‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইয়ে সিলেটের জঙ্গলে বাঘ মারার কাহিনি বলেছেন এনায়েত মওলা। ওটা কানাইঘাটে- পরিত্যক্ত নুনছড়া ও লুভাছড়া চা বাগানের আশেপাশে। শুধু সিলেট অঞ্চল নয়, খোদ ঢাকার মিরপুর আর এয়ারপোর্ট এলাকাতেও লেখক বড় বাঘ আর শিকার করেছিলেন বেতারের চাকুরির সময়ে, সেটা পঞ্চাশের দশকে।
কাপ্তাইয়ের গভীর জঙ্গলের কাঠ কাটতে যাওয়া প্রাচীন কাঠুরেরা আজও দাবি করেন পঞ্চাশ ষাটের দশকে সেখানে বড় বাঘ দেখার। এনায়েত মওলার ধ্রুপদী ‘যখন শিকারি ছিলাম’ বইতে কাসালং রিজার্ভের মাইনি, মাহিল্লা এসব এলাকায় ১৯৫৭-৫৮ সালের দিকে বাঘ মারার কাহিনীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
এবার একটু চট্টগ্রামের দিকে যাই। এরশাদ উল্লা খান তার ‘চট্টগ্রামের শিকার কাহিনী’ বইয়ে ১৯৫৫ সালে চুনতির ওহাইদ্যা ঘোনায় (আরাকান রোডের পাশের পাহাড়ে) বাঘ শিকারের বর্ণনা করেছেন। সেসময় কক্সবাজারের হিমছড়িতে আস্তানা গাড়া বিশাল আকারের একটি বাঘের কাহিনিও বলেছেন তিনি। কক্সবাজার, টেকনাফ, নীলা এসব জায়গায় এক সময় রাত হলেই বাঘের গর্জন শোনা যেত।

পাবনা অঞ্চলের জমিদার কুমুদনাথ চৌধুরী তার ‘ঝিলে জঙ্গলে শিকার’ বইয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছিলেন সে এলাকার বাঘ শিকারের। সেটা ১৯১৭-১৮ সালের কথা। খুব কী বেশি আগে?
২০১৫ সালে এক শুমারিতে দেখা গিয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমে ১০৬-এ নেমেছে৷ গত মে মাসে প্রকাশ করা সর্বশেষ শুমারির ফলাফলে দেখা গেছে চার বছর আগের ১০৬টি থেকে বেড়ে মোট বাঘ ১১৪টি হয়েছে৷ অর্থাৎ চার বছরে আটটা। মোটেও খুশির খবর নয়।
তার ঠিক উল্টো খবর দেখলাম ভারতের খবরে। পনের বছর আগেও যেখানে বাঘ ছিল ১৪০০, আজ ভারতে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে তিন হাজার। এর অর্থ দাড়াচ্ছে ব্যাপারটা যদি বাংলাদেশ হতো, তাহলে পনের বছরে সেই ১০৬টি বাঘ গিয়ে দাঁড়াতো ১৩২ এ, ভাবা যায়? ভারতকে বলা হচ্ছে, Safest region in the world for tigers, পাশের দেশ আমাদের। ঠিক পাশের দেশ।
আমি সব সময় বলি, ভারতের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। তারা যেভাবে একটি বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীকে কঠোর মনিটরিং আর আন্তরিকতার মাধ্যমে একটি স্বাস্থ্যবান জনসংখ্যায় টেনে আনতে পেরেছে, তা আমাদের বর্তমান সোনার বাংলায় অন্তত কখনো সম্ভব নয়। আমি আশাবাদী নই। ওপারে ভালো থেকো বাঘেরা।
লেখক: অভিযাত্রী ও প্রাণিপ্রেমী, বাংলাদেশ
***প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বেঙ্গল ডিসকাভার কর্তৃপক্ষ লেখকের মতামতের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।